নিজস্ব প্রতিবেদক
জমিতে ঘাম ঝরিয়েও ভালো নেই লবণ ও সবজি চাষীরা। চলতি অর্থ বছরে ৬৯ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ ও ৩৬ হাজার ১৮৩ মেট্রিক টন জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। জমিতে চাষাবাদ বেশি করায় স্বাভাবিকভাবে উৎপাদনও হয়েছে বেশি। কিন্তু দামে ঠকেছে লবণ ও সবজি চাষীরা। অথচ চাষীদের উৎপাদিত লবণ বেছে মিল মালিকরা ও সবজি বেছে পাইকাররা ঠিকই লাভবান হয়েছে। লবণ ও সবজির এমন দর পতনে আগামীতে চাষাবাদে অনাগ্রহী হয়ে পড়তে পারে চাষীরা। বেশি উৎপাদন করেও চাষীরা লাভবান না হওয়ার পেছনে বিপণন ব্যবস্থাকেই দুষছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিসিক লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. ওমর ফারুক পূর্বদেশকে বলেন, ‘চলতি বছর চট্টগ্রামে লক্ষ্যমাত্রার অধিক শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। উৎপাদনও ভালো হয়েছে। তবে কৃষকরা তুলনামূলকভাবে ভালো দাম পায়নি। প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সে সবজিগুলো বাজারে ঠিকমতো বিপণন করা যায়নি। এই সবজিগুলো বাইরের দেশে রপ্তানী করা গেলে দাম মিলতো। এখন উৎপাদিত সবজির বেশিরভাগই লোকাল বাজারে সরবরাহ করা হয়েছে। কৃষি পণ্য বিপণনে আরও জোর দিতে হবে। আমরা সে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।’
কক্সবাজারের বিসিক লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভ‚ঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন, কৃষকরা দামটা নিয়ে একটু হতাশ। প্রতি মণ লবণ বিক্রি করে দাম পাচ্ছে ২২৫ টাকা। সামনে একটু দাম বাড়বে বলে আশা করছি। মাঠে এখনো উৎপাদিত লবণ আছে। নতুন উৎপাদিত লবণসহ এখন ৫লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ মজুদ আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লবণের দাম বাড়বে।
জানা যায়, নভেম্বর মাস হতে মে মাস পর্যন্ত সময় লবণের উৎপাদনের মৌসুম। এসময় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় লবণ উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত লবণেই দেশের সাড়ে ২৫লাখ টন চাহিদার মূল যোগান দেয়া হয়। একইভাবে শীত মৌসুমে চট্টগ্রামে প্রচুর শীতকালীন সবজি উৎপাদিত হয়। আলু, বেগুন, মূলা, পাতাকপি, ফুলকপি, টমেটো উৎপাদন হয় বেশি।
বিসিক জানায়, টেকনাফ, কুতুবদিয়ার লেমশীখালী, ঈদগাঁওয়ের গোমাতলী, মহেশখালীর উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা, মাতারবাড়ি, চকরিয়ার ডুলাহাজারা, ফুলছড়ি, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, চট্টগ্রামের পটিয়া ও বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনা, ছনুয়া, সরলে প্রায় ৪৪ হাজার চাষী এবার লবণ চাষ করেছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে লবণের ভালো দাম পেয়েছিল লবণ চাষীরা। যে কারণে গত অর্থ বছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরে দুই হাজার ৫৭৬ একর বেশি জমিতে আরও চার হাজার ৫৩৩ জন চাষী লবণ চাষে মাঠে নামে। কিন্তু উৎপাদন শুরুর পর থেকেই লবণের দাম কম পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন চাষীরা। গত অর্থ বছরে ৪৫০-৫৫০ টাকা পর্যন্ত প্রতি মণ লবণের দাম পেয়েছিল চাষীরা।
বাঁশখালীর খুদুকখালী এলাকার লবণ চাষী আব্দুর রহিম পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি দশ কানি জমিতে লবণ চাষ করেছি। প্রতি কানিতে ১০-১৫ মণ লবণ পাওয়া গেছে। এসব লবণ প্রতিমণ ২৯০ টাকা বিক্রি হলেও খরচ বাদ দিয়ে পেয়েছি ২৫০ টাকা। লবণের দাম কমপক্ষে ৪০০ টাকা দাম না পাওয়া পর্যন্ত লোকসানই গুনতে হবে। লবণ বেশি উৎপাদন হলেও দাম না পাওয়ায় চরমভাবে হতাশ হয়েছি। গতবার দাম ভালো পাওয়ায় আগ্রহ নিয়ে লবণ চাষে নেমেছিলাম। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে লবণ চাষ কমে যাবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চট্টগ্রামে গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩৩ হাজার ১০৩ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছিল। যে কারণে চলতি অর্থ বছরে ৩৩ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৬ হাজার ১৮৩ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দুই হাজার ৯৭৫ হেক্টর জমিতে বেশি সবজি আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে মিরসরাইয়ে এক হাজার ৯২৬ হেক্টর, সীতাকুন্ডে পাঁচ হাজার ৪০০ হেক্টর, ফটিকছড়িতে ছয় হাজার ৫ হেক্টর, হাটহাজারীতে ৯২০ হেক্টর, রাউজানে এক হাজার ৪৫০ হেক্টর, রাঙ্গুনিয়ায় দুই হাজার ৮৭৫ হেক্টর, পাঁচলাইশে ৩৩৭ হেক্টর, ডবলমুরিংয়ে ১৬৩ হেক্টর, পতেঙ্গায় ৩৭৩ হেক্টর, বোয়ালখালীতে ৮৯৭ হেক্টর, পটিয়ায় এক হাজার ১১১ হেক্টর, কর্ণফুলীতে ১৮৪ হেক্টর, আনোয়ারায় এক হাজার ৩৮৪ হেক্টর, চন্দনাইশে দুই হাজার ২৫৭ হেক্টর, লোহাগাড়ায় এক হাজার ৩২৩ হেক্টর, সাতকানিয়ায় দুই হাজার ২১৩ হেক্টর, বাঁশখালীতে তিন হাজার ২৩২ হেক্টর ও স›দ্বীপে চার হাজার ১৩৩ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে।
বাঁশখালীর সরল এলাকার টমেটো চাষী শাহদত আলম বলেন, ‘আমরা আগাম জাতের টমেটো চাষ করেছি। সারাবছর টমেটোর দাম থাকলেও শীতে টমেটোর দাম কমে যায়। বাজারে এখন টমেটো প্রতি কেজি ১৫ টাকা বিক্রি হলেও আমরা পাইকারদের কাছে টমেটো বিক্রি করছি অর্ধেক দামে। যে কারণে টমেটো চাষে যে খরচ হয়েছে তা তুলতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। পচে যাওয়ার ভয়ে দাম বাড়ার অপেক্ষা না করেই দ্রæত বিক্রি করতে হয় বলেই সুযোগটি কাজে লাগায় পাইকাররা।’