লটারিতে ভর্তির নেতিবাচক প্রভাব ও ভর্তি পরীক্ষার প্রয়োজনিয়তা

1

মুহাম্মদ মাহফুজুল আলম

একজন শিক্ষার্থী যখন প্রাথমিক শিক্ষা তথা ৫ম শ্রেণি শেষ করে, তখন সে হাই স্কুলে ভর্তি হয়। এক্ষেত্রে ঐতিহ্যগতভাবে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি চালু থাকলেও ২০২১ সাল থেকে ভর্তি পরীক্ষার বদলে লটারির মাধ্যমে ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। অভিভাবকসহ শিক্ষা সচেতন মহলে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তখন থেকেই। তারা বলছেন এটি প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার বিরুদ্ধে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। মাধ্যমিক পর্যায়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণেও নেতিবাচক ফল পেয়েছি। তাই মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা। থাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছি।
(১) ভর্তি পরীক্ষা থাকলে শিক্ষার্থী বছর ব্যাপী যে প্রস্তুতি নেয়, তা পরবর্তী শ্রেণির জন্য তাকে অধিকতর উপযোগী করে তোলে। ফলে কাক্সিক্ষত কোনো স্কুলে কোনো কারণে না টিকলেও যেখানেই ভর্তি হোক না কেনো, সে প্রস্তুত হয়েই ভর্তি হয়। ফলে ঐ শ্রেণিতে সে যথেষ্ট ভালোভাবেই মানিয়ে নিতে পারে।
(২) সাংবিধানিকভাবে নিজের যোগ্যতা ও পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যেকোনো শিক্ষার্থীর অধিকার। লটারিতে গেলে সেই অধিকার হরণ করা হয়। শিক্ষার্থীও নিজেকে আরো দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলার স্পৃহা হারায়।
(৩) ভর্তি পরীক্ষা না রেখে লটারি থাকলে দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণির শিক্ষার্থী অন্য শ্রেণিতে আবেদন করছে। জন্ম নিবন্ধন করানোর ক্ষেত্রেও ঝামেলা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে তুলনামূলকভাবে বয়স ও শিক্ষার মানদন্ডে অনুপযুক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে একই ক্লাসে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থী থাকছে। স্তর অনুযায়ী যে পাঠদান তাতো ব্যাহত হচ্ছেই; পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাও ব্যাহত হচ্ছে।
(৪) হাইস্কুল পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা থাকলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাও দৃশ্যত জবাবদিহিতার মধ্যে চলে আসে। এদিকে পিইসিই পরীক্ষা না থাকলে কিংবা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি না করলে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী কী শিখলো, সেই বিষয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এমনকি অভিভাবক পর্যন্ত উদাসীন থাকেন। চ্যালেঞ্জ না থাকলে শিক্ষাকে মানোত্তীর্ণ পর্যায়ে নেওয়া কঠিন।
(৫) সারাদেশে লটারিতে ভর্তি হলেও ক্যাডেট কলেজসহ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি করায়। এটি স্পষ্টতই বৈষম্য। বাস্তবেই যদি লটারি ফলপ্রসূ হতো তবে ক্যাডেট কলেজ, নটরডেমসহ স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহেও সেটি চালু হলো না কেনো?
(৬) ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থী হাইস্কুলে চলে আসলে প্রাথমিক স্তরের যে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা তার অর্জন করে আসার কথা, সেগুলো অর্জন ছাড়াই সে চলে চলে আসছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। ফলে সেগুলো অর্জন করতে তাকে হাইস্কুল পর্যায়ে বেগ পেতে হচ্ছে এবং নতুন স্তরের যোগ্যতাসমূহ অর্জনে সে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে সে তুলনামূলকভাবে একজন দুর্বল শিক্ষার্থীকে পরিণত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে। নেতিবাচক ফলাফল সহজেই অনুমেয়া
তবে, শিশু শ্রেণি বা ১ম শ্রেণিতে লটারিতে ভর্তি করানো যেতে পারে যেহেতু শিক্ষার্থীর শিখন প্রক্রিয়াই শুরু হয় না তখনো। কিন্তু, হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষা থাকা উচিত। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া অন্য যেকোনো বিকল্পই অর্থবহ হবে না। বৈষম্যহীন যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তার বাস্তবায়ন হতে হবে শিক্ষা ক্ষেত্র থেকেই। একজন নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থীকে যদি কাক্সিক্ষত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সুযোগ দিতে না পারি আমরা, তাকে তো শুরুতেই বৈষম্যের শিকার করে দেওয়া হবে। তাই, লটারি পদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তি পদ্ধতি পুনরায় চালুর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : সহকারী শিক্ষক (ভৌতবিজ্ঞান), আবদুর রহমান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পটিয়া, চট্টগ্রাম।