
রত্না চৌধুরী নোটন
সব সন্তানই বাবা-মায়ের কাছে রাজপুত্র-রাজরানীর মতো। মানুষ করে পরম মমতার আঁচলে ঢেকে। অনেক পরিবারে দেখা যায় সন্তান বড় হয়েছে তবুও মুখে তুলে খাইয়ে দেয়,গোসল করিয়ে দেয়, আলতো আদরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, মাধ্যমিক পর্যন্ত নেশার মতো আগলে রাখে। পরবর্তীতে জীবনের নিয়মে তাদের ছেড়ে দিতে হয়।পড়ালেখা শেষ করে একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে এই আশা নিয়ে এগোয় আমাদের বাবা- মায়েরা।পড়ালেখার তাগিদে প্রথম যখন সন্তানকে একা ছেড়ে দেয় তখন বাবা-মায়ের সেকি আহাজারি! ভয়ে,আতঙ্কে, চাপে দিন কাটে সেই বাবা- মায়ের। সন্তান ঠিকঠাক চলছে কিনা,পড়ালেখা করছে কিনা,নিরাপদে থাকছে কিনা,নিজের আত্মসম্মান নিয়ে ভাবছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক বাবা- মাকে দেখেছি এইচ এস সিতে ভালো ফলাফল করে ভর্তি যুদ্ধে টিকে থাকার পরও সন্তানদের হাত ছাড়া করে না শুধু নিরাপত্তার অভাবে।কিন্তু এভাবে কতদিন? একদিন না একদিন ছাড়তে তো হবেই।নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কম বয়সে সন্তানদের চ্যালেঞ্জতো নিতেই হবে।
মেধার জোরে ভর্তি হয় বুয়েটে, চুয়েটে, মেডিকেলে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তারা সেখানে ভর্তি হয়ে কতটুকু নিরাপত্তায় আছে বলুনতো? বাবা- মায়ের উদ্বিগ্ন মন আর বসে না। চাপযুক্ত হৃদয় নিয়ে তাদের জীবন কাটে।আমার সন্তান ভালো আছে তো এই ভেবে!
শত শঙ্কা, শত ত্যাগ, শত দৃশ্যের ভালোবাসাকে চাপা দিয়ে সন্তানকে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠায়।বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী প্রথম ভর্তি হয়ে স্বাভাবিক ভাবে তাদের অনেক কিছুই অজানা থাকে।নতুন পরিবেশে কিভাবে চলতে হয়, কিভাবে থাকতে হয় তারা তখন বুঝে উঠতে পারে না।আর ঐদিকে মানুষ নামের বর্বর পশু গুলো দেশ টাকে আর দেশের মাঝে রাখেনি।প্রতিদিন খুন,ধর্ষণ,অত্যাচার,আগুন লাগিয়েই রাখে। এতসব পরেও সন্তানদের জন্য বাড়তি চাপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র্যাগ নামক অপসংস্কৃতি। সিনিয়র কর্তৃক জুনিয়র শিক্ষার্থীদের উপর নিত্য চলে র্যাগিং।শুনেছি সিনিয়রদের কাপড়- চোপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সারাদিন ক্লাসে আটকে রাখা, শীতের সকালে খালী গায়ে খালী পেটে দাঁড়িয়ে রাখা, টয়লেট পরিষ্কার করা,ট্রেনে বা বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছা,টাকা কেড়ে নেওয়া, নজরদারি করা, অনিচ্ছা সত্তে¡ও কিছু করানো, নিয়মিত খবরদারি করা ইত্যাদি। এসব র্যাগিং এর কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন।তাদেরকে যদি র্যাগ এর পরিবর্তে সিনিয়ররা নার্সিং করতো তাহলে হয়তো শিক্ষার পরিবেশ হতো আরো উন্নত। জুনিয়রদের কাছে র্যাগিংটা আতঙ্কের। দূর্বিষহ এই প্যারা সবাই নিতে পারে না।এমনও দেখা যায় সেইসব অত্যাচারিত, নিপীড়িত শিক্ষার্থী একটু মুক্তভাবে চলার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়।র্যাগিংটা তিরস্কার না হয়ে আবেগে ভালো কিছুইতো হতে পারতো। কিন্তু না চিত্র উল্টো। যে পেয়েছে সে মনে রেখেছে দ্বিগুণ। সেজন রেগ দিয়েছে আরো বাড়িয়ে। ইদানীং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও বাজেভাবে র্যাগিং হতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রীতিনীতি শেখানোর জন্য শিক্ষকরা কোন যথেষ্ট হতে পারে না? যদি হতো তবে এমব বর্বর র্যাগ এর প্রচলন হতো না।জধম যদি হয় নোংরামি ভরা, অশ্লীল কথাবার্তা তাহলে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা কই? রেগিং এর কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে শুনেছি।এ নোংরামির শেষ কোথায়? যারা রেগ দিচ্ছে তারাও আমাদের সন্তান আর যারা পাচ্ছে তারাও আমাদের সন্তান। আমরা কি পারিনা এমন বর্বর চিন্তাভাবনার প্রস্থান ঘটাতে? এই রেগিং বিষয়টাকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে না নিয়ে আমরা কি পারিনা থামাতে? সিনিয়র হলেই কি রেগ দিতে হবে? আমি মনে করি এসব সিনিয়রদের নোংরা মানসিকতার পরিচয়। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং আা রেগিং প্রতিরোধ নীতিমালা তৈরি করেছে যা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা করার কথা কিন্তু হচ্ছে কি? সবকিছুর প্রমাণ লাগে।প্রমাণ দিতে গেলেই নানা বাধা। বাধায় বাধায় তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দূর্বিষহ। কে যাবে এসব প্রতিকারে? সবাই নিরবে সয়ে যায়। প্রতিবাদ করে না।
প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে আশা করছি শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠবে রেগিং মুক্ত।
লেখক : শিক্ষিকা, কক্সবাজার











