রেল হাসপাতালে এখন সবাই পাবেন চিকিৎসা

2

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ থাকে বেশি। সে তুলনায় রেলওয়ে হাসপাতালগুলোতে রোগীর উপস্থিতি নগণ্য। এসব হাসপাতালে শুধুমাত্র রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবা গ্রহণ করার সুযোগ থাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যাও থাকে কম। রোগী সংকটে এক প্রকার অলস সময় পার করেন রোগীর সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সরা। যে কারণে গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম সফরে এসে রেলওয়ে হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষও যাতে চিকিৎসা সেবা পায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
উপদেষ্টার এমন ঘোষণার ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।এই সমঝোতা স্মারকের ফলে রেলওয়ে পরিচালনাধীন হাসপাতালগুলোতে রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। সরকারের এ সিদ্ধান্ত রেলওয়ে হাসপাতালের আওতাধীন এলাকার মানুষের জন্য সুখবর বটে। কিন্তু এমন সুখবরের মাঝেও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রেলওয়ে হাসপাতালের ‘চিকিৎসক সংকট’। যদিও এ সংকট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, ‘রেলওয়ে হাসপাতালে বিদ্যমান জনবল কাঠামোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ না থাকায় উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তিতে পদায়নে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলওয়ে হাসপাতালে যাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয় সে বিষয়ে দুইপক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে’।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭৮টি চিকিৎসকের পদের বিপরীতে কর্মরত চিকিৎসক আছে ২০ জন। উচ্চশিক্ষা জটিলতা, ডেপুটেশন না পাওয়া, শর্তসাপেক্ষে শিক্ষাছুটি ও নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়ার কারণে নন-ক্যাডার পদের রেল চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটের কারণে রেল কর্মচারীদের আস্থায় না থাকায় এই হাসপাতালগুলোতে রোগী সংকট থাকে। পূর্বাঞ্চলের ঢাকা, সিআরবি ও পাহাড়তলীতে তিনটি, পশ্চিমাঞ্চলে চারটি হাসপাতাল আছে। উভয় অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ডিসপেনসারি (মিনি হাসপাতাল) আছে।
পূর্বাঞ্চলে ৪১ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১৩ জন। পশ্চিমাঞ্চলে ৩৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন সাত জন। চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ চিকিৎসকের মধ্যে আছেন মাত্র চারজন। তথ্যমতে, ৭৮টি পদের মধ্যে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের দিকে দুটি নিয়োগের পর ৪১ জন চিকিৎসক থাকলেও এখন আছে মাত্র ২০ জন। এই দুই নিয়োগে যোগ দেয়া চিকিৎসকদের মধ্যে ২১ জন বর্তমানে কর্মরত নেই। চিকিৎসক সংকট নিরসনে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে চাহিদাপত্র দেয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এখন রেল মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের চুক্তির পর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দিলে রেলের ‘অকার্যকর’ হাসপাতালগুলোতে আবারো প্রাণ ফিরবে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবার দ্বার উন্মোচিত হবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (সিএমও) ডা. ইবনে সফি আব্দুল আহাদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘রেলওয়ে হাসপাতালে সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পাবে এটা দারুন সুখবর। আমাদের যে জনবল আছে তা দিয়ে চিকিৎসা দেয়া কঠিন হবে। তবে রেলওয়ে হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্সসহ নানা পদে জনবল পদায়ন করলে ভালোভাবেই সেবা দেয়া যাবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এই জনবল পদায়ন করবে বলে জেনেছি। যত দ্রæত সম্ভব চিকিৎসক পদায়নসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হলে আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদানে আমাদের সুবিধা হবে’।
রেল-স্বাস্থ্য বিভাগের চুক্তি : রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যৌথ ব্যবস্থাপনায় রেলওয়ে হাসপাতালসমূহ সর্ব সাধারণকে সেবাদানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে। এসব হাসপাতালে অধিক সংখ্যক মানুষ স্বাচ্ছন্দে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের লক্ষ্যে গতকাল সোমবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান নিজ নিজ দপ্তরের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন।
সমঝোতা স্মারকের শর্ত মোতাবেক বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালসমূহ রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলপোষ্য ও রেলওয়ের যাত্রীসাধারণের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের জন্য চিকিৎসা সুবিধা উন্মুক্তকরণ এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাথে যৌথভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলপোষ্য ও যাত্রী সাধারণের চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল সুযোগ-সুবিধা পূর্বের মতো বহাল থাকবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালসমূহের সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এ সমঝোতা স্মারকের শর্ত মোতাবেক যৌথভাবে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত ও পরিচালিত হবে। বিদ্যমান জনবল কাঠামোর অধীনে নিয়োগকৃত জনবলের প্রশাসনিক ও সংস্থাপনিক কার্যক্রম বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতায় পূর্বের মতো বলবৎ থাকবে। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত ইনভেন্টরি কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুসারে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ হাসপাতালের সকল অস্থাবর সম্পত্তি বুঝে নিবে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজনের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। রেলওয়ে হাসপাতালে বিদ্যমান জনবল কাঠামোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ না থাকায় উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তিতে পদায়নে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সমঝোতা স্মারকের আওতায় রেলওয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সেবা প্রদান ফি বাবদ আদায়কৃত অর্থের ব্যবস্থাপনা সরকারি হাসপাতালসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধি-বিধান অনুযায়ী হবে। হাসপাতালসমূহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য রলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে এবং প্রতিটি হাসপাতালের জন্য পৃথক পৃথক স্থানীয় যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। এই ব্যবস্থাপনা কমিটির গঠন ও কার্যপরিধি সরকার কর্তৃক আদেশের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে।
সমঝোতা স্মারক অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুল রহমানসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।