রেলওয়েতে ‘বড় অপরাধে’ দায়ী কর্মকর্তার লঘুদন্ড!

3

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেলাল হোসেন সরকার। বিগত সাত বছর ধরেই রেলের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণের চাবি তাঁর হাতে। বর্তমানে প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) পদে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে দায়িত্ব পালন করছেন। দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্ত, শাস্তি কোনকিছুই এই কর্মকর্তার পদচ্যুতি ঘটাতে পারেনি। উল্টো পদোন্নতি পেয়েছেন। সর্বশেষ পশ্চিমাঞ্চলে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক থাকাকালে ক্রয় প্রক্রিয়া আইন অনুসরণ না করে পছন্দের ছয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেয়া, ওটিএম পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতামূলক পণ্য ক্রয় না করে এলটিএম পদ্ধতিতে ক্রয় করা, ১৭৯ জন ঠিকাদারের সাথে বৈষম্যের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তবে এমন বড় অপরাধের পরেও গত ১৮ জুন এই কর্মকর্তাকে লঘুদন্ড দিয়ে এক বছরের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছে। যে কারণে বিগত সরকার আমলের দাপুটে কর্মকর্তা বেলালের খুঁটির জোর কোথায় তা নিয়ে রেলঅঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
রেলের উর্ধ্বতন পর্যায়ে কাজ করা সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রেলের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে হয়তো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে লঘুদন্ড দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে কারণে তাকে শাস্তি পেতে হয়েছে তা চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করতে পারে। তদন্তে যদি পুনরায় দোষী সাব্যস্ত হন তাহলে ভিন্ন শাস্তিও পেতে পারেন। তখন দীর্ঘসময় সরঞ্জাম দপ্তরে চাকরি করে তিনি কি পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন তাও পরিষ্কার হবে।’
জানা যায়, ২০১৮-২০২০ সাল পর্যন্ত প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন সরকার সিওএস কন্ট্রোলার অব স্টোরস (সিওএস) পূর্ব ও পশ্চিম পদে দায়িত্ব পালন করেন। রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) দপ্তর সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে কারখানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন বিভাগের দৈনন্দিন পরিচালন কাজে প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী যা দেশে উৎপাদিত বা আমদানিকৃত অবস্থায় দেশিয় বাজারে প্রাপ্তিযোগ্য তা ক্রয় ও সংগ্রহের কাজ করবে। দুই অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি জড়িয়ে পড়েন বেলাল সরকার। এমন একটি দুর্নীতির অভিযোগে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে পণ্য ক্রয়ে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (অডিট ও আইসিটি) ড. ভুবন চন্দ্র বিশ^াসের তদন্ত টিম রেকর্ডপত্র, ক্রয় করা পণ্য এবং বাজার থেকে সরেজমিনে সংগৃহীত পণ্যের নমুনার বাজারদর যাচাই এবং পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি বিবেচনাপূর্বক তদন্ত করে বেলাল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ পায়। সেসময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের হলে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক হিসেবেই দায়িত্ব পান। গত ২৯ ডিসেম্বর পাহাড়তলী প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিসিএস) পদে যোগ দেন প্রকৌশলী বেলাল হোসেন সরকার।
গত ১৮ জুন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম স্বাক্ষরিত রেলওয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল হোসেন সরকার পশ্চিমাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক থাকাকালে তার বিরুদ্ধে আনীত অসদাচরণ এর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৪ (২)(খ) বিধিমতে ‘বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি পরবর্তী এক বছরের স্থগিত’ রাখার লঘুদন্ড প্রদান করা হলো। তিনি স্থগিতকৃত বর্ধিত বেতনের বকেয়া প্রাপ্ত হবেন না, এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় বছর হতে বর্ধিত বেতন প্রাপ্য হবেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বেলাল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে ক্রয়কার্যে অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা থাকায় সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী ‘অসদাচরণ ও দুর্নীতি’র অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়ে করা হয়। তিনি মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণ কমিটি কর্তৃক বাজারদর অপেক্ষা অধিক দর দেখিয়ে দাপ্তরিক প্রাক্কলিত দর সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে প্রেরণ করেন এবং তা তিনি যাচাই না করে অনুমোদন করেন। এই কর্মকর্তা ওটিএম পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ থাকা সত্তে¡ও এলটিএম পদ্ধতিতে ক্রয় করেন। এছাড়াও মেসার্স আলমগীর ট্রেডার্স, মো. আনোয়ার হোসেন রাজা, মেসার্স শাহ রুপস ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স আশা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জীবন এন্টারপ্রাইজ ও মো. দিদারুল ইসলাম নামীয় রাজশাহী মহানগরের ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কপি দেখিয়ে টেন্ডার নোটিশ জারি করেন। তালিকাভুক্ত ১৭৯জন ঠিকাদারের মধ্যে ছয়জন ছাড়া বাকি ১৭৩জনকে কিংবা বাংলাদেশ রেলওয়ের স্থানীয় অন্য কোন দপ্তরে টেন্ডার নোটিশের কপি দেননি। এমনকি নিজ দপ্তরে বা অন্য কোন দপ্তরের নোটিশ বোর্ডেও তা প্রচারণ করেননি। তিনি টেন্ডারকার হিসেবে টেন্ডার চুক্তির শর্ত মোতাবেক পণ্য আসবাবপত্র সোফাসেট ও স্টিলের চেয়ার মানসম্মতভাবে গ্রহণ নিশ্চিতকরণে কোন কার্যকর ভূমিকা পালন করেননি।
এমন অভিযোগনামা, অভিযোগ বিবরণী, অভিযুক্তের লিখিত জবাব, বিভাগীয় মামলা সংক্রান্ত দলিলাদি পর্যালোচনায় অভিযোগ গুরুতর প্রতিয়মান হওয়ায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে তদন্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্তকালে বেলাল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বহীন আচরণ, অবহেলাল কারণে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি দায়িত্বশীল পদে থেকেও দায়িত্ব অবহেলার মাধ্যমে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া যথাযথভাবে আইন অনুসরণ না করেননি। যা সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী ‘কর্তব্যে অবহেলা প্রদর্শন’ যা অসদাচরণের সামিল বলে প্রতিয়মান হয়। যে কারণে এই কর্মকর্তাকে এক বছরের বর্ধিত বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার লঘুদন্ড দেয়া হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে রেলওয়ের প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল হোসেন সরকারকে কয়েকদফা ফোন দেয়া হলেও তিনি লাইন কেটে দেন।