রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বিষয়ে সরকার কী ভাবছে ?

1

ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম

রেমিট্যান্স একটি দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে। অর্থাৎ রেমিট্যান্স হচ্ছে একটি দেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, টেকসই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলার সংকট নিরসন, আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য ও দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তথাপি, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো সচল ও মজবুত রাখছে প্রায় এক কোটি বিশ লাখ রেমিট্যান্স যোদ্ধা। যার ফলে দেশের মাথাপিছু আয় ও মোট জিডিপিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়াও প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের দারিদ্র্যমোচন থেকে শুরু করে খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত বিবেচনায় সেখানে শ্রমবান্ধব কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। যা আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স ও মানোন্নয়ন করতে সরকারি প্রচেষ্টার কিন্তু কমতি ছিল না। সে তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দ্বিতীয় উৎস সত্তে¡ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দু’টি কিন্তু বিতর্কিত। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবাসীদের জন্য কোনো আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে এদের প্রশ্রয়ে দশকের পর দশক ধরে চলছে দালালদের দৌরাত্ন্য। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হলে অর্থনীতির চরম দুর্দিনে প্রবাসীদের পাঠানোর রেমিট্যান্স অর্থনীতির পরম উপশম ও মহৌষধ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এদের চরম কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে। কিন্তু এ দেশের তথাকথিত কিছু উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চশ্রেণির এলিট শ্রেণি রয়েছে। যারা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে দেশ থেকে বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করে বেগমপাড়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজপ্রাসাদ গড়ছে। তারাই নাকি এ যুগের সূর্যসন্তান। অন্যদিকে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলা মায়ের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। আর ডলার সংকটের সময়ে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিকে রক্ষা করছে। তথাপি, দেশের ক্রান্তিকালে অগ্রসৈনিক রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে তারা দেশের কী সন্তান? সুশীল সমাজ জানতে চায়। বিশেষত দেশের এ যাবৎ কালের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অন্যতম জ্বালানি হলো রেমিট্যান্স। কিন্তু যারা অর্থনীতির চাকার জ্বালানি জোগান দিচ্ছে। তাদের প্রাপ্য সম্মান কতটুকু দেয়া হচ্ছে। তথাপি, দেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে অর্থাৎ বিমানবন্দর আগমনে কিংবা নির্গমন উভয় ক্ষেত্রেই বিভিন্ন রকম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চাদরে ঢাকার কারণে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের জন্য ভোগান্তির যেন শেষ নেই। অর্থাৎ দেশের বিমানবন্দর অথবা দূতাবাস ও ভিসা প্রসেসিং, দালালচক্র ও বিমান টিকেট বাণিজ্য সিন্ডিকেটের দৌরাত্ন্য কিংবা পাসপোর্ট অফিসের দুর্ভোগ ও লাগেজ নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রেই হয়রানিতে নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে প্রবাসীদের। এমনকি প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের দেহ দেশে ফেরত আনতে তাদের পরিবারকে অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এ ধরনের অশোভন ও অমানবিক আচরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এছাড়াও প্রবাসীরা রেমিট্যান্স বৈধ পথে পাঠাতে প্রবাসী ব্যাংক ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত রেমিট্যান্স হাউস ও এক্সচেঞ্জ হাউসের জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দ্বারস্থ হতে হয়। যা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পক্ষে সহজতর নয়। তাই অবৈধ পথে অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না। এ কারণে হুন্ডি বা অন্য চ্যানেলে প্রবাসীরা অর্থ পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। কিন্তু জনশক্তি খাতের নীতি, নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতার এ সব ক্ষেত্রেই যেন সমন্বয়ের বড় ঘাটতি বিদ্যমান। তাছাড়া আগামী দিনগুলোতে এশিয়ার উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে কৃষি ও শিল্প খাতে বিভিন্ন পেশার দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে। এক্ষেত্রে আসিয়ান অঞ্চলভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে অষ্ট্রেলিয়া ও কানাডায় কৃষি খাতে দক্ষ জনবলের আকর্ষণীয় চাকরির সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ জনবলের চাহিদা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, জার্মানিতে যেখানে উচ্চমানের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীদের কারণে শিল্প খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটছে। সে তুলনায় আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষায় তেমন আশানুরূপ অগ্রগতি নেই বললেই চলে। তাই শিক্ষিত ও দক্ষ জনবল বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে ভারত ও নেপালসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদেশে যাওয়ার খরচ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। এ কারণে দৃশ্যমান বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ভারতীয় ও শ্রীলংকান অথবা নেপালি প্রবাসীকে ভিআইপি মর্যাদা দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তারা দেশের মধ্যে গর্ব নিয়ে অবাধে চলাফেরা করছে। আর সাধারণ মানুষ প্রবাসীদের বরণ করছে। এদের ভালোবাসা দিতে কিন্তু কোনো ধরনের কার্পণ্য করছে না। সে তুলনায় আমাদের দেশে প্রবাসীরা প্রাপ্ত সম্মানটুকু পায় না। সে সাথে দূতাবাসগুলো প্রবাসীদের জন্য যে ধরনের সেবা দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো দৃশ্যমান সেবা পাচ্ছে না। বিশেষটি লক্ষণীয় যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় প্রবাসীরা দেশের পাশে দাঁড়িয়ে যে অবদান রেখেছিলেন। সে অবদান কখনো ভোলার নয়। তবে প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো বন্ধ করে তৎকালীন সরকারকে আর্থিক চাপে ফেলে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বিগত সরকারের প্রতি অনাস্থা ও সহমত পোষণ করে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স না পাঠানোর ঘোষণা দেন। এতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রবাসীরা সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এর কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার ৫৭ জন বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়। এর ফলে রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে এ ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণও কমতে থাকে। বিশেষত ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হলে নতুন সরকারকে শক্তিশালী করতে প্রবাসীরা বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর ঘোষণা দেয়। এতে দেশ গঠনে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে অনেক প্রবাসী ক্যাম্পেইন শুরু করে। যার ফলে আবারও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ এ বছরে দেশে ঈদে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ আয়। এর ফলে দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুতসহ বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হচ্ছে। তাই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পুরোটাই দেশের মুদ্রায় ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি রিজার্ভ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তাই প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা যত বেশি বৃদ্ধি করা সম্ভব। আর তত বেশি দেশে রেমিট্যান্স আসবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছে। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল থাকলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। কাজেই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা বিশেষ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদেশে যাওয়া আরও সহজীকরণ করা উচিত। অর্থাৎ বিমান ভাড়াসহ সকল ব্যয় কমানো যেতে পারে। এতে করে রেমিট্যান্স যোদ্ধার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন যথাযথ সহায়ক হবে। এজন্য দেশপ্রেমিক রেমিট্যান্স এ যোদ্ধাদের আর উপেক্ষা করা উচিত হবে না। আর বিমানবন্দরে দুর্ভোগ ও ভোগান্তি জাতীয় পর্যায়ে প্রবাসীদের বিষয়ে সরকারি নীতি ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কাঠামোগত দুর্বলতা ও সমম্বয়ের ঘাটতির দূর করতে হবে। তাই শ্রমবাজার ধরে রাখতে কিংবা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে হলে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির কোনো বিকল্প নেই। তবে লো ভ্যাল-অ্যাডেড থেকে হাই ভ্যালু-অ্যাডেড রপ্তানি খাতে উত্তরণের এ রকম লক্ষ্য আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। এ আচরণে টেকসই পরিবর্তন আনতে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় দৃষ্টি দিয়ে মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আর প্রবাসীদের জন্য দেশে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাতে দেশে ফিরে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে। বর্তমানে প্রবাসীরা দেশে এসে বিভিন্ন ধরনের জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের বিনামূল্যে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সু-চিকিৎসাসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এজন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি, অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলবিজয়ী ড. মুহামদ ইউনূস রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। সে সাথে প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে পাবে। এটাই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সময়ের দাবি।

লেখক : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ