নিজস্ব প্রতিবেদক
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণেই রাঙামাটির আরেক নাম ‘রূপের রাণী’। পাহাড়, নদী, লেক ও মেঘ বেষ্টিত বৈচিত্রময় এ জনপদ যেন ভরাট, দখল, দূষণ ও ভাঙ্গনে বিপর্যস্ত। রাঙামাটির অপার সৌন্দর্য্য কাপ্তাই লেকের ৩৬ পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাল্টে গেছে তিন নদী ও ১০ খালের গতিপথ। ভরাট হয়েছে প্রায় ৯১ কিলোমিটার নদী-খাল। জেলা শহর ও ১০টি উপজেলার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী নৌপথের নাব্যতা ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নদী-খাল ও কাপ্তাই হ্রদের প্রাণ ফেরাতে ৬৯৬ কোটি টাকার ‘রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কর্ণফুলী এবং সংযুক্ত নদীসমূহের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। ২০২৩ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও সেটি ফেরত দেয়া হয়। অন্তবর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব নিলে ঝিমিয়ে পড়া প্রকল্প আবারো গতি পায়।
গত ১০ নভেম্বর রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, ‘ষাটের দশকে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর এখনও ড্রেজিং না হওয়ায় তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। হ্রদে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের কারণে এর আয়তন দিন দিন কমছে। কাপ্তাই হ্রদ এই এলাকার মানুষের জীবিকা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মৎস্যসম্পদ। পাশাপাশি যোগাযোগেও ব্যাঘাত ঘটে। দ্রæত হ্রদে ড্রেজিংসহ দখল ও দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
রাঙামাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা পূর্বদেশকে বলেন, রাঙামাটির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত বিভিন্ন নদী, খাল ও কাপ্তাই হ্রদ ভাঙ্গন থেকে রক্ষায় নেয়া প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাঙামাটির ১০টি উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ নৌপথেই চলাচল করে। অথচ শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেলে নাব্যতা সংকটের কারনে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ১৩টি নদী-খাল খনন ও হৃদের তীর রক্ষার মাধ্যমে লেকের পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে মৎস্য উৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা ও পর্যটনের বিকাশ ঘটবে। প্রকল্পে ৬৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা স্যারও কাপ্তাই হৃদের খনন জরুরী বলে মতামত দিয়েছেন। যে কারনে রাঙামাটিতে নেয়া পাউবোর প্রথম মেগা প্রকল্পটি দ্রæত সময়ের মধ্যে অনুমোদন হবে বলেই আশা করছি। অনুমোদনের পর জানুয়ারিতে প্রকল্প কাজ শুরু হলে ২০২৮ সালের জুনে প্রকল্প কাজ শেষ হবে’।
পাউবো সূত্র জানায়, রাঙামাটি শহর, বরকল, লংগদু, বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর, কাউখালী, কাপ্তাই, জুরাছড়ি ও রাজস্থলী উপজেলা ঘিরে প্রকল্প এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকল্পের অধীনে তীর সংরক্ষণ কাজ, কাচালং নদী খনন, রাইখিয়ং নদী খনন, শলক নদী খনন, ১০টি খাল পুনঃখন ও বিভাগীয় দপ্তর নির্মাণ করা হবে।
কাপ্তাই হ্রদের বাঘাইছড়ির আটটি স্থান, লংগদুর চারটি, বরকলের পাঁচটি, রাঙামাটি সদরের পাঁচটি, কাপ্তাইয়ে চারটি, বিলাইছড়িতে একটি, রাজস্থলীতে তিনটি, নানিয়ারচরে দু’টি, কাউখালীর চারটি পয়েন্টে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এই ৩৬ পয়েন্টে প্রায় ১১ দশমিক ৭৫০ কিলোমিটার তীর প্রতিরক্ষা কাজ করা হবে। বাঘাইছড়ি, লংগদু ও বরকল উপজেলার কাচালং নদী, জুরাছড়ির শলক নদী ও বিলাইছড়ির রাইখিয়ং নদীর ৬৫ দশমিক ৭০ কিলোমিটার এলাকার খনন করা হবে। এছাড়াও বাঘাইছড়ি ও লংগদুর করঙাতলী খাল, জীবংগছড়া খাল, সিজক শাখা কাল, সরোয়াতলী খাল, আমতলী কাল, আমতলী শাখা খাল, দিপর মুখ খাল, গুলশাখালী খাল, গুলশাখালী শাখা খাল, লংগদু খালের ২৫ দশমিক ৮৫০ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হবে।
কাপ্তাই এলাকার পর্যটকবাহী ট্রলার চালক শাহ আলম বলেন, ‘পানি কমে গেলে কাপ্তাই থেকে নৌ চলাচল করা যায় না। যে কারণে পাহাড়ের বিভিন্ন উপজেলা থেকে জেটিঘাট বাজারে লোকজন আসতে পারে না। পর্যটকরাও নৌকা নিয়ে ভ্রমন করতে পারে না। কাপ্তাই লেকের সাথে সংযোগ হওয়া খালগুলোতে পানি কমে গেলে নৌকা চলাচল করে না। কাপ্তাই লেকও দখল হয়ে যাচ্ছে। আবার পানি বাড়ার কারণে অনেক জায়গায় ভাঙন বেড়েছে। ভাঙনের কারণে বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে কাপ্তাই লেক ও খালগুলো রক্ষায় কখনো কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি’।
স্থানীয় বাসিন্দা তরুণ চাকমা বলেন, রাঙামাটি শহরের তুলনায় বহু মানুষ গভীর পাহাড়ের উপজেলাগুলোতে বসবাস করে। সেখান থেকে মানুষজন একমাত্র নৌপথেই যাতায়াত করতে হয়। বাজার কিংবা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে শহরে লোকজনের যাতায়াত বেশি। কিন্তু পানি কমে যাওয়ার কারনে অনেক সময় দূরদূরান্ত থেকে নৌকা আসতে পারে না। তখন দুর্ভোগ বেড়ে যায়। পাহাড়ের নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। নদী-খাল খনন করা জরুরী। বহুদিন যাবত কাপ্তাই লেক, নদী-খাল খনন হবে শোনা গেলেও কার্যত উদ্যোগ দেখা যায় না।
রাঙামাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা পূর্বদেশকে বলেন, ‘রাঙামাটির প্রকল্পটি একবার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে যাচাই সভা শেষে যেসব সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে তার আলোকে সংশোধন করে আবারো পাঠানো হয়েছে। এখন বোর্ড থেকে প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে আগামি মাসে পরিকল্পনা কমিশনে যাবে। প্রকল্পটি হয়তো আগামি কয়েক মাসের মধ্যে অনুমোদন হবে বলে আশা করছি।’