রাসলীলা মাহাত্ম্য

2

পলাশ কান্তি নাথ রণী

শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুরে কোন এক কার্তিকী পূর্ণিমায়, সহস্র বর্ষ আগে গোপীনীরা ছুটে গিয়েছিলেন বৃন্দাবনের অরণ্যে। সে সময় পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ নিজের অনেকগুলো প্রতিরূপ সৃষ্টি করলেন। রাসমন্ডলে যতজন গোপী ছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে তত সংখ্যক করে, সে গোপীদের প্রত্যেকের সঙ্গে নৃত্য করলেন। কেউ ভাবতে পারলেন না, শ্রীকৃষ্ণ তার সঙ্গে নেই। রাসলীলায় এক কৃষ্ণ দেখা দিলেন বহু কৃষ্ণ রূপে। এই ব্যাপারটার একটা রূপক অর্থ আছে। আকাশে চাঁদ একটাই। কিন্তু বহু জলাশয়ে তা প্রতিবিম্বিত হতে পারে। তেমনই, ব্রহ্মান্ডে শ্রীকৃষ্ণ একজনই, কিন্তু তিনি প্রতিবিম্বিত হতে পারেন অসংখ্য ভক্তের অন্তরে। এক পরমেশ্বর বিরাজ করেন বহু ভক্তের হৃদয়ে এটা রাসলীলার একটা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য।
রাস শব্দটি সংস্কৃত ‘রস’ শব্দ থেকে এসেছে। রস মানে আনন্দ, দিব্য প্রেম। লীলা মানে দৈবিক কাজ। এখানে কাজ অর্থে এক প্রকার নৃত্যের কথা বলা হয়েছে। রাস হল এক দৈবিক নৃত্য। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের সাথে হল্লীশ নৃত্য করেছিলেন। হল্লীশ নৃত্য যদি তাল যুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাকে রাস নামে অভিহিত করা হয়। কথিত আছে যে যেসব মুনি-ঋষি অনেক সাধনা করেও শ্রীরামচন্দ্রের দর্শন পাননি তাদের মনে আফসোস ছিল। দ্বাপরে তারাই গোপীরূপে আবির্ভূত হয়ে তাদের স্বপ্ন পূরণ করেন। গোপীদের চক্রাকারে নাচ হলো জন্ম-মৃত্যু চক্র। প্রত্যেক গোপীর সাথে শ্রীকৃষ্ণের অবস্থান হলো ভগবান অন্তর্যামী সকল জীবের মাঝে আত্মা রূপে বিদ্যমান। চক্রের মাঝে ছিলেন পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর পরাশক্তি শ্রীমতী রাধারাণী। রাস নৃত্যের অর্থ আমাদের জীবন-মৃত্যুর মাঝে আমরা বারবার আবর্তিত হই। মায়া মোহসহ ষড়রিপু আমাদের এই বৃত্তে আটকে রাখে। কিন্তু আমাদের গন্তব্য হল বৃত্তের কেন্দ্রে পৌঁছানো অর্থাৎ পরমাত্মায় বিলীন হওয়া। মায়া ষড়রিপুর জাল ছিঁড়ে আমাদের জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমন্বয়ে নিজেদের আত্মার থেকে মায়ার পর্দাকে সরিয়ে নিতে হবে- এই পর্দা না সরালে আমরা পরম আত্মার স্বরূপ বুঝতে পারব না।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘Raas leela is an external expression of divine leela which takes place in the heart of each and every individual, between the finite and the universal soul.’ অর্থাৎ পরমাত্মার সঙ্গে অন্তরাত্মার সংসর্গের যে দিব্যলীলা চলে প্রত্যেক মানুষের অন্তরে, তারই প্রকাশ ঘটে রাসলীলায়।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃতে চৈতন্য মহাপ্রভুর বয়ানে বলা হয়েছে-
‘অন্যের হৃদয় মন আমার মন বৃন্দাবন
মনে বনে এক করি জানি।’
অর্থাৎ মন এবং বৃন্দাবনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। বলাবাহুল্য, প্রকৃত রাসলীলা সংঘটিত হয় বাহিরে নয়, ভক্তের অন্তরে; ভৌগোলিক বৃন্দাবনে নয়, মনের বৃন্দাবনে। অন্য কথায়, মানুষের দেহের অভ্যন্তরেই ঘটে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা। রাসলীলা তাই দেহতত্তে¡র রূপকও বটে। রাসলীলার আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য অনুধাবন মানুষকে দিতে পারে অনাবিল আনন্দ, সেই সঙ্গে দিব্য অনুভূতি আর দিব্য প্রেমের আস্বাদ। আর এ-সবই হচ্ছে রাসলীলার প্রকৃত রস।
লেখক : সাবেক কলেজ শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, বাগীশিক কেন্দ্রীয় সংসদ