রাষ্ট্রীয় সম্পদ, পুলিশ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমালে ও মঠ-মন্দিরে হামলা গ্রহণযোগ্য নয়

8

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

আমরা কমবেশি দুঃখ মিয়ার গল্প জানি বা শুনেছি; দুঃখ মিয়া হলেন, আমাদের প্রাণের জাতীয় কবি, সাম্যের কবি ও মানবতার কবি। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। জন্ম ভারতের কলকাতার পশ্চিম বর্ধমান জেলার পুরুলিয়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখনও কবি বাকরুদ্ধ ছিলেন। ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া করার কিছু ছিলোনা। ১৯৭৪ সালে এক সংবর্ধনায় তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালে ২৯ আগস্ট তৎকালীন ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তিনি বাংলাদেশের রণসঙ্গীতের রচয়িতা। এটি তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। ‘বিদ্রোহী’- “বল বীর-বল উন্নত মম শির, শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর! বল বীর-বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি, চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি, ভূলোকে দ্যুলোকে গোলক ভেদিয়া, খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাতৃর! মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর, বল বীর আমি চির উন্নত শির, আমি চির দুর্দম দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর! আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল, আমি মানিনা কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা ডুবি, আমি টর্নেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন! আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর! আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর! বল বীর চির-উন্নত মমশির…” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ দীর্ঘ কবিতা আওড়াতে আওড়াতে ভাবি, ১৯৬৫ সালে মহাভারত দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে বিভাজন হয়। আশ্চর্য্যের বিষয় ভারতে থেকে যায় অসংখ্য সংখ্যালঘু মুসলমান। যা কিনা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫ কোটিরও অধিক। অবশ্য মুসলমান ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। এ বিশাল জনসংখ্যার ভার কি গ্রহণ করার অবস্থা আমাদের আছে ? বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। তার সাথে যোগ হয়েছে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এ অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর তীব্র চাপে কক্সবাজার জেলা ও টেকনাফ, রামু উপজেলা অনেকটা ন্যূব্জ, তা হলে অবস্থা অতি সহজে বুঝাযায়- তবে বিশ্বের সর্বোচ্চ জনগণত্বের দেশ বাংলাদেশ। কোনোভাবেই ভাবা যায়, একের ওপর তিন বহন করার অবস্থা কি আমাদের আছে? এমনিতে আমাদের শ্বাস নিশ্বাস নেবার জায়গাও নেই। তাহলে খেয়ে না খেয়ে মরতে হবে সকলকে। লক্ষ্য করুণ, আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ৫০টি। আয়তনে আমাদের চেয়ে ১০০ গুণ বড়। দেশটির জনসংখ্যা মাত্র ৩২ কোটি। কিন্তু দেশটি বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিধর রাষ্ট্র। সেই পরিস্থিতি সামলে দিতে হিমসিম খেতে হয়; সঙ্গে দেশটিতে মাঝে মাঝে দেখাদেয় বর্ণবাদী সংঘাত ও অভিবাসন জটিলতা। রাজনীতি অস্থিরতা যে একেবারে নেই, তা বলবো না; অপরদিকে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই আছে। নারী-শিশুসহ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে শুধু সাম্প্রতিক সময়ে। তারমধ্যে ২০ হাজারও অধিক শিশু রয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে ২৫ হাজারও অধিক শিশু। বলতে হয়, গাজা উপত্যকার অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই, যেদিকে তাকাবে ধ্বংসের স্তূপ আর ধ্বংসের স্তূপ। অথচ একসময়ে তাদেরও কি শানসৌকত জীবন-যাপন ছিল! নিয়তির কি খেলা, তাঁরা এখন উদ্বাস্তু, হাত পেতে থাকতে হয় কখন ত্রাণসামগ্রী আসবে! অথচ মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলো ইচ্ছে করলে শয়ে শয়ে জাহাজভর্তি খাদ্যসামগ্রী দিয়ে ভাসিয়ে দিতে পারে। তারা কি দেয় বা দেয়ার মতো পরিবেশ আছে; আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে তারা টালমাটাল-দিশাহারা; দাঁড়াবে কি করেই প্রযুক্তি বলতে কিছু আছে তাদের; দূরদৃষ্টিতে মনে হয়ত ইরান পরাশক্তিধর রাষ্ট্র। কিন্তু দেশটির আভ্যন্তরিণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বড়ই নাজুক। ক্ষণে ক্ষণে সর্বোচ্চ নেতা ও কর্মকর্তাদের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এজন্য ইরান বরাবরই ইসরায়েলকে দায় করে আসছে। কথা হলো, ইরান ইসরায়েলের আভ্যন্তরে গিয়ে কি এ যাবত কোনোপ্রকার নাশকতা বা অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা ঘটাতে পেরেছে? যদিওবা তা কখনো কামনা করি না। তারপরও বলতে হয়, করার মতো সেই শক্তি নেই ইরানের! তাঁদের নিরবে নিরবে মার খেয়ে হজম করতে হবেই।
৫ আগস্ট (২০২৪ খ্রি.) আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হয় অর্থাৎ আওয়ামীলীগের টানা ১৬ বছরের শাসনকাল অবসান হয়! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমায়। আপাতত দৃষ্টিতে বলতে হয়, কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ বিজয় এবং আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হয়। এটি ছাত্র আন্দোলনের অভূতপূর্ব বিজয় বলা যায়। ছাত্রদের আবেগকে সম্মান দিতে হয়। অতীতেও বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের বহু শৌর্যবীর্যে হৃদগৌরব আছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে জেনারেল আয়ূবের ভীত ভেঙে পড়ে, শেষতক বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু এবারের ছাত্র আন্দোলনকে কোন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করা হবে; আপাতত সরকার পতনের বিজয় স্বস্তি ফিরলেও এখনো মূল্যয়ানের ক্ষণকাল আসেনি- বলতে হয় এখনো মুকুল বা শিশু, একটু থেকে একটু এদিক সেদিক হলে সবই ভেস্তে যাবে। তবে এসবের আলামত বা লক্ষণ কি তাঁরাও বুঝেন, যাঁরা প্রথম থেকে জড়িত আছেন। অবশ্য এরমধ্যে যা দেখা যাচ্ছে, সর্বত্র চরম বিশৃঙ্খলা- মারধর জ্বালাও পোড়াও। এমন কি ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করা। দুর্বৃত্তায়নে এমন কোন কাজ নেই, যা সংঘটিত হচ্ছে না। এ পর্যন্ত ৪ শতাধিক থানা আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি থানা থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ লুটপাটসহ মূল্যবান নথিপত্র ধ্বংস করা হয়েছে শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের মঠঃ-মন্দিরও ভাংচুর এবং জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ থেকে তৃণপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট, আগুন দেয়াসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা করা হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, ‘প্রতিটি ঘটনার সমপরিমাণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে।’ রাজনৈতিক ভাষা হবে সহনীয় পর্যায়ে এবং শত্রুর সাথে আলিঙ্গন করা, যেন বুঝতে না পারে তুমি তার প্রতিপক্ষ। লড়াই হবে আদর্শের এবং জনপ্রিয়তা বাড়বে আচার-আচরণে। মনে রাখতে হবে জবরদস্তি বা জবরদখলের বিরুদ্ধেই- এ বিজয়। অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ লড়াই, দুর্বৃত্তায়ন করার জন্য। আরো মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের তৃতীয় দিকে ভারত, অপর একটি সীমান্তবর্তী এলাকা মিয়ানমার রাষ্ট্র। দেশটিতে চলছে হানাহানি ও গৃহযুদ্ধ। মাঝে মাঝে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে, গোলাও আছড়ে পড়ে। ওদের জাতিগত, গোত্র, বর্ণ ও ধর্মীয়ভাবে বহু বিভাজন আছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। সেদিক থেকে সীমান্তগত অবস্থা সুবিধাজনক নয়; অনেকে বলে থাকেন সেন্টমার্টিন দখলের হীন চেষ্টাও আছে দেশটির। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লুলোপ দৃষ্টি রয়েছে এ ছোট নয়নাভিরাম দ্বীপটির প্রতি।
আগেই বলেছি, অপর সীমান্তের তিনদিকে ভারত। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রটি বাংলাদেশ ব্যাপারে সর্বদলীয় বৈঠকও করেছে। সঙ্গে আওয়ামীলীগের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়েছে। আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তাদের বিশেষ দুর্বলতা আছে । তাই তারা চাইনা হানাহানি। সংখ্যালঘ্যুদের উপর নিপীড়ন এবং ধর্মীয় স্থাপনা বিনষ্ট করা। তারা এ-ও বলে যাচ্ছে, ১ কোটি শরণার্থী গ্রহণ করবে নির্দ্বিধায় ; তারপর কি হবে? ভারত সংখ্যালঘু রক্ষায় যেকোন প্রদক্ষেপ নিতে পারে বা নিলে আমাদের করার কিবা থাকবে; আওয়ামীলীগ- দলটিতো একেবারে জনবিচ্ছিন্ন সংগঠন না। স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রধান শক্তি ও সমর্থক। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতনসহ হিন্দু সম্প্রদায় এবং অন্যান্য জাতি, উপজাতি-পাহাড়ি, নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীসহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিশাল অবস্থান। অতএব সাবধান! ইচ্ছে করে সাপের লেজে পা দিলে খবর আছে! মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালের কথা…। ৬ আগস্ট, দিবাগতরাতে, আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয়, প্রবীণ শিক্ষক ও বহু গ্রন্থের রচিয়তা জনাব নজির আহমেদ মাস্টার- স্যার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক স্টেটাস দেন। এটি সবার দৃষ্টি কাড়ে- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। জাতি-ধর্ম-বর্ন নির্বিশেষে যা করণীয় উচিত।
১. রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। ২. যেকোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করুন। ৩. ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ থেকে বিরত থাকুন। ৪. রাজনীতি করুন, দলের কেনা গোলাম হবেন না। ৫. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পুজা করবেন না, বিবেককে হাজির-নাজির জানুন। ৬. মানুষের জন্য রাজনীতি, রাজনীতির জন্য মানুষ নয়। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়তা স্থায়ী, রাজনৈতিক সম্পর্ক অস্থায়ী। ৭. রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করুন। ৮. নেতার পূজা করবেন না, নীতির পূজা করুন। ৯. গনতন্ত্র কাকে বলে তা ভালো করে জেনেনিন। ১০. মানুষের সেবা করুন। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনীতি করবেন না। ১১. দল করুন, দলবাজি করবেন না। ১২. নিজের দেশকে ভালো রাখুন, বিদেশের দালালি করবেন না। ১৩. আত্মসমালোচনা করুন, ভুল করলে সংশোধন করুন। ১৪. দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সবাইকে সালাম।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট