বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে দেশে রক্তপাতহীন একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটেছে গত সোমবার। এ অভ‚্যত্থানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছাত্র- জনতার। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের সর্বশ্রেণির ছাত্রদের অংশগ্রহণের ফলশ্রæতিতে দীর্ঘ সাড়ে পনের বছরের শাসন-শোষণের অবসান হয়েছে। ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর দেশের মানুষ আশা করে, দেশে আর কোনরকম নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, প্রতিহিংসা কিংবা হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিকান্ডের মত ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু সোমবার ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। গণভবন, সংসদ ভবন থেকে শুরু করে শত শত থানা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন হয়েছে, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে, বাড়ি-ঘরে হামলা হয়েছে। এসময় কোথাও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি দৃশ্যমান হয়নি। এ সুযোগে মূলতঃ বিভিন্ন স্থানে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়েছে। লক্ষ করা গেছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর পাওয়ার পরপরই সোমবার দুপুর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী শুরু হয় শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের বিজয়োল্লাস। এ সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকে পড়েন। অনেকে সেখানে ভাঙচুর ও লুটপাটে অংশ নেন। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। ভাঙচুর চালানো হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে। হামলার শিকার হয় কয়েকটি গণমাধ্যম কার্যালয়। রাজধানীতে পুলিশ সদর দপ্তর এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় নির্বিচার হামলা চালানো হয়। চট্টগ্রামে কোতোয়ালি থানা, চান্দগাঁও থানাসহ মেয়রের বাসভবন, সারা দেশে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও দলটির নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। দুটি জেলখানা থেকে কয়েদি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যেখানে কয়েকজন জঙ্গিও ছিল বলে অনলাইন সংবাদে প্রচার হয়েছে। অনেক স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন সূত্রে এ জাতীয় সহিংস পরিস্থিতিতে সোমবার ১০৪ জন এবং মঙ্গলবার ১০৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যেখানে অনেক পুলিশের সদস্যও ছিল। এ ধরনের কর্মকান্ড বন্ধে সারা দেশে অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা। ইতোমধ্যে সেনাপ্রধান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক এবং আন্দোলনের সমর্থক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সব ধরনের প্রতিশোধপরায়ণতা ও অরাজকতা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ জাতীয় ধ্বংসযজ্ঞে উদ্বেগ প্রকাশ করে সকলকে শান্ত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা মনে করি, এ ধরনের প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা দেশে অরাজকতার জন্ম দিয়েছে, যা ছাত্র-জনতার বিজয়ের মাহাত্ম্যকে কিছুটা হলেও ম্লান করেছে। এ অবস্থা আর মোটেই চলতে দেয়া যায় না। যত দ্রæত সম্ভব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ বাহিনীকে কাজে ফিরিয়ে এনে উদ্ভূদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। আমরা মনে করি, যে কোনো মূল্যে দেশে আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে হবে।
গণঅভ্যূত্থানের পর দেশে দ্রুত শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করছে মানুষ। একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছেন সবাই। সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের এ পরিবর্তনের দিকে। এ সময় হামলা, অগ্নিকান্ড, ভাঙচুর ও লুটপাটের দৃশ্য বহির্বিশ্বের কাছে কোনো ভালো অর্থ বহন করবে না, বরং ক্ষুন্ন করবে দেশের ভাবমূর্তি। তাই দেশের কোথাও যেন সুযোগসন্ধানীরা আর এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক ও সংযত থাকতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সোমবার বিভিন্ন স্থানে হামলা, অগ্নিকান্ড ও ভাঙচুরের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে সর্বত্র। মঙ্গলবার সারা দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেওয়া হলেও সেসব স্থানে মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। জানা যায়, গতকাল দুপুর ১২টার আগেই ভয়ে-আতঙ্কে সচিবালয় থেকে বের হয়ে যান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্কুল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি ছিল একেবারে নগন্য। এমনকি বুধবারের ছাত্র-ছাত্রী স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন উপস্থিত হয়নি। বস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করায় মানুষের নিরাপত্তাবোধের অভাব বৃদ্ধি পাওয়াই এর কারণ।
এ পরিস্থিতিতে জনগণের জানমাল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, উপাসনালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। অভ্যুত্থানের পর তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। এতে জনমনে নানা সংশয় দেখা দিচ্ছে। সরকার গঠনের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করে জনগণের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার্থে অবিলম্বে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হবে-এমনটি প্রত্যাশা দেশবাসীর।