রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি নিয়ে জটিলতা কোথায়?

2

বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের পদচ্যুতির দাবিতে আন্দোলন শুরুর পর রাষ্ট্রপ্রধানকে সরানোর উদ্যোগ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ কিংবা অপসারণের ক্ষেত্রে কিছু সাংবিধানিক জটিলতা সামনে এসেছে। আচমকা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিরোধিতা করে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে এতে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারনের দাবি তুলে আন্দোলন শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার জন্য গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় ছাত্ররা।
ছাত্রজনতার দাবির পর সরকার রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়টিকে গণদাবি হিসেবেই সামনে এনে সুরাহার উদ্যোগ নিয়েছে। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়টি উঠেছে এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন স্পিকারের নিকট। আর তাকে অপসারণ করতে পারে নির্বাচিত সংসদ। এখন সংসদ বিলুপ্ত আবার স্পিকারও পদত্যাগ করেছেন। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দেশে রাজনৈতিক সংকট এবং সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি পদটি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। গণঅভ্যুত্থান এবং পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের পর অন্তর্র্বতী সরকার রাষ্ট্রপতির থাকা না থাকার বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখছে।সরকারের পক্ষ থেকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির থাকবে কি থাকবে না এটি আইনি কিংবা সাংবিধানিক বিষয় নয় এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে এর সমাধান হতে পারে। রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকার সবচে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ‘রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন) বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বা পদত্যাগের কোনো সাংবিধানিক পথ খোলা নেই। সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন। এদিকে সংবিধানও স্থগিত করা হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের সুযোগ না থাকায়, রাষ্ট্রপতিকে এখন অপসারণ করা হলে, সেটি সংবিধানের বাইরে গিয়ে করতে হবে, যেটি একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগ করলে কিছু জটিলতার দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে, ৫ অগাস্টের পরে এই রাষ্ট্রপতি এই অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ করিয়েছেন এবং তিনি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। যদি ৫ অগাস্টের পরে আগের সরকারের সংসদ, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার সকলকে বাদ দিয়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটির বরাত দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা নিয়ে সরকার গঠিত হতো, তাহলে আজ এ প্রশ্ন উঠত না।
রাষ্ট্রপতি না থাকলে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের ব্যাপারটি কীভাবে করতে হবে এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হাফিজুর রহমান বলছেন, এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি কীভাবে পদত্যাগ করবেন এবং নতুন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে ঘিরেই হবে জটিলতা। নতুন সরকারের কিছু কর্মকান্ড সংবিধান অনুযায়ী হয়েছে, আবার অনেক কর্মকাÐ হয়েছে সংবিধানের বাইরে। ফলে একটা হ য ব র ল বা বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়ছে। এখন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে, সংসদ না থাকায় সংবিধান অনুযায়ী নতুন কোনো রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা যাবে না। সেটি একটি সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক শূন্যতা তৈরি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান কোনো সংকট নয়।
“এই আন্দোলনের পর তখনই যদি তারা চাইতো রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হতো। সুতরাং সংবিধান যদি বলেন তাহলে তো ইন্টেরিম গভর্মেন্টও আসে না। কারণ আমাদের সংবিধানেতো নাই এটা। আগে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ছিল সেটা কিন্তু এখন নাই। সুতরাং অন্তর্র্বতী সরকার যদি হয় জনগণের ইচ্ছায় তাহলে সংবিধানের প্রথমেই লেখা আছে জনগণ ক্ষমতার মালিক। ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ। জনগণ যদি উৎস হয় আর জনগণ যদি চায় তাহলে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে। আর এটাতো জনআন্দোলন ছিল। বিশাল একটা ম্যাস মুভমেন্ট। এই মুভমেন্টের ফলে সেই মুহূর্তে যেটা হতে পারতো সেটা এখনো পারে। এখানে সংবিধানের কোনো ভঙ্গ হচ্ছে বা কিছু হচ্ছে এমন কিছু হবে না।”
রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়ে গত বুধবার বিএনপি তাদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে বলেও উল্লেখ করেছেন দলটির নেতারা।
গত বুধবার বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, “এই পদটা একটা সাংবিধানিক পদ, একটা প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় সংকটের সৃষ্টি হবে।”
বিএনপির এ অবস্থানের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে এ প্রশ্নে অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, “যেহেতু বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে করে মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিস্ক্রিয় ও শক্তিহীন করার চেষ্টা হতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সতর্ক ও সচেতন হয়ে গেছে। তাছাড়া সংস্কার কবে নাগাদ শেষ হবে, সেটি স্পষ্ট নয়, এবং নির্বাচনি কোনো রোডম্যাপও না দেওয়াতে বিএনপি এমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বলে আমার ধারণা।”
তিনি মনে করেন বিএনপির আপত্তির কারণেই রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়টি এখনই হচ্ছে না। তবে অন্তর্র্বতী সরকার যেহেতু বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চায় তাই বিতর্ক এড়াতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রথম প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায়, এবং বিএনপির তরফ থেকে সাংবিধানিক শূন্যতার কথা বলায়, এখন বলা হচ্ছে যে, এটি রাজনৈতিক বিষয় এবং এজন্য ঐকমত্য দরকার। প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যমত হলে বিতর্কটা কম হবে বা বিতর্ক কিছু হলেও, সেটি মোটামুটি মান্যতা পাবে; কেননা, বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে মীমাংসিত অনেক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অপ্রয়োজনীয় ও ভিত্তিহীন বিতর্ক তোলা হয়েছে”।
বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অবস্থান হলো ৫ অগাস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে, তাদের ভাষায় নতুন বাংলাদেশে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি বিদায় করার সঙ্গে বিদ্যমান সংবিধানও রাখা হবে না।
আপাতত রাষ্ট্রপতি অপসারণ এবং নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া কীভাবে হবে সেটি নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সমাধানের দিকে দৃষ্টি তাদের। তবে বিষয়টি নিয়ে বিএনপি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতে এখনই রাষ্ট্রপতির থাকা না থাকার প্রশ্নে রাজনৈতিক অনৈক্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেখছেন অনেকে।