রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে কর হার বাড়বে বাজেটে

1

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় রাজম্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, প্রতিবছর গতানুগতিক বাজেট লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। এবার তেমনটি হবে না। এবারের বাজেট হবে সিগনিফিকেন্ট, ব্যবসাবান্ধব বাজেট। তবে বাজেটে ঘাটতি থাকবে, কিন্তু যাতে মূল্যস্ফীতি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে কর হার বাড়ানো হবে। দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আদায় বাড়ানো এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর আগ্রাবাদ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সম্মেলন কক্ষে প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব করতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের পক্ষে আয়কর বিষয়ক ১৯টি, ভ্যাট বিষয়ক ৪০ ও শুল্ক সংক্রান্ত ৫৫টি প্রস্তাবনা দেন চট্টগ্রাম চেম্বার।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এবারের বাজেট হবে ব্যবসাবান্ধব। বাজেটকে জনবান্ধব করতে ব্যবসায়ীসহ সকলের মতামত নেওয়া হচ্ছে, যার প্রতিফলন পাওয়া যাবে বাজেটে। আগামী বাজেটে ঘাটতি থাকবে কিন্তু যাতে মূল্যস্ফীতি না হয় সেই দিকেও লক্ষ্য রাখা হবে। আর রাজস্ব আদায়ে যৌক্তিকভাবে বাড়ানো হবে করহারও। মার্কিন শুল্ক আরোপের ফলে দেশের পোশাকখাত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। ব্যবসায়ীরা যাতে এনবিআর অফিসে ঘুরতে না হয় সেজন্য সবকিছু অটোমেশন করা হচ্ছে। এখন সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে এক লাখ ৬০ হাজার সার্টিফিকেট অনলাইনে প্রদান করা হয়েছে। আয়করের মতো ভ্যাটও যেন ঘরে বসে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে ভ্যাট হার যৌক্তিকীকরণ, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ট্যাক্স রেট কমানো, ট্যাক্সনেট বৃদ্ধি ও রিফান্ড ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা হবে। তিনি বলেন, প্রশাসনিক জটিলতা সহজীকরণ করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এজন্য অটোমেশনে জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি। কোনো কাজ করতে কোথাও যাতে যেতে না হয় সে লক্ষ্যেই কাজ করছি আমরা। আমি চাই ব্যবসায়ীরা কম্পিউটারের সামনে বসে থাকবে। অনলাইনেই প্রয়োজনীয় কাজ হয়ে যাবে। এর ফলে এবার অনলাইনে ১৫ লাখ ৩০ হাজার অনলাইন রিটার্ন পেয়েছি। ব্যবসাবান্ধব করতে এনবিআরকে অটোমেশন করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, কর প্রদানে আমরা এরই মধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছি। এখন কর দিতে কোনো ব্যাংকে যেতে হবে না। এর ফলে কমিশন খরচ হবে না। সরকারি কোষাগারে টাকা জমানো হবে সরাসরি। ভ্যাট ও আয়করে অডিট সিলেকশনে ব্যক্তি জড়িত থাকবে না এমন কাজ করছি আমরা। এর ফলে মাঝখানে কেউ প্রতারণা করার সুযোগ পাবে না। যারা ব্যবসা বাণিজ্য করছেন, দেশের জন্য কর্মসংস্থান করছেন তারাই রিয়েল হিরো। সরকার ১৫ লাখ মানুষকে চাকরি দিয়েছে। বাকি অনেক বড় অংশের চাকরি কিন্তু বেসরকারি খাতে।
ভ্যাট কমানোর প্রস্তাবের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, আমরা একক হারে ভ্যাট কমাতে প্রস্তুত, তবে সব পণ্যে একই হার হতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও প্রকৃত ভ্যাট প্রদানের ব্যাপারে সৎ হতে হবে। এনবিআর প্রতি মাসের পরিবর্তে ত্রৈমাসিক ভ্যাট নিরীক্ষা চালু করার চিন্তা করছে এবং ভ্যাট ব্যবস্থাকে আরও স্বয়ংক্রিয় করতে কাজ করছে।
বন্ড সুবিধার অপব্যবহার নিয়েও কঠোর মন্তব্য করে তিনি বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য করমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা নেওয়া হলেও তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়। স্বর্ণের ক্ষেত্রে তো আমদানি রেকর্ডই নেই, অথচ বাজারে টনকে টন স্বর্ণ পাওয়া যায়।
রিকন্ডিশন গাড়ির বাজারে আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ১৫ লাখ টাকায় আমদানিকৃত গাড়ি ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে- এটা দেখেই বোঝা যায় আন্ডার-ইনভয়েসিং হয়েছে। এজন্যই ৫০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে বাধ্য হচ্ছি।
জাহাজভাঙা শিল্পে আমদানি শুল্ক নিয়েও সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, দেখতে অযৌক্তিক মনে হলেও এসব শুল্ক না থাকলে জাহাজগুলোতে মূল ওজনের চেয়ে বেশি তেল আসবে- এটা সুবিধার অপব্যবহারের উদাহরণ।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশার সভাপতিত্বে প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় করেন সভায় উইমেন চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, বিজিএমইএ, রাঙামাটি ও কক্সবাজার চেম্বারসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি খলিলুর রহমান বলেন- শেয়ার বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। শেয়ারের উপর ৪০ শতাংশ এবং ডিভিডেন্ডের উপর ২৫ শতাংশ দিলে কী থাকে উদ্যোক্তাদের। তিনি এই করহার কমানো এবং প্রাইভেট কোম্পানীগুলোর করহার কমানোরও আহবান জানান। তিনি বলেন, মেশিনারিজের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। আমদানি রপ্তানি আরও সহজ করতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি সরওয়ার জামাল নিজাম বলেন, বাংলাদেশের এখনও ৫৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ভ্যাটকে সহনীয় পর্যায়ে এনে জনসাধারণের যাতে সুবিধা হয় সে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সরাসরি যেসব ট্যাক্স আছে সেগুলো কমিয়ে আনা হোক।
বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অডিটকে কত সহজভাবে করা যায়, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ আলোচনা যাতে আমলে নেওয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে আলোচনা হলেও এর প্রতিফলন বাজেটে দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি এরশাদ উল্লাহ বলেন, গত ১৫ বছর এ চেম্বারে গঠনমূলক কিছু হয়নি। আমি মনে করি, আগামী বাজেট গণমুখী হবে। চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রস্তাবনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এইচএসকোড নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। এগুলো সমাধান করতে হবে।
উইমেন চেম্বারের সভাপতি আবিদা মোস্তফা বলেন- দেশের এসএমই খাতের ভ‚মিকা রাখছে নারী উদ্যোক্তারা। তাই আগামী বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের এসএমই খাতে সুযোগ সুবিধার বাড়ানোর আহবান জানান তিনি।
সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, চেম্বারের সাবেক পরিচালক কামাল মোস্তফা চৌধুরী ও জহিরুল ইসলাম চৌধুরী (আলমগীর), পার্ক শিপিং লাইন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী, টি কে গ্রুপের এডভাইজর জাফর আলম, লুব-রেফ’র এমডি মোহাম্মদ ইউসুফ, এইচআরসি’র সিনিয়র পরিচালক কাজী রুকুনউদ্দীন আহমেদ, খাগড়াছড়ি চেম্বার পরিচালক নজরুল ইসলাম, টেরীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান, সাধারণ সম্পাদক আবুল মনসুর, তামাকুমন্ডি লেন বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক, বিকেএমইএ’র পরিচালক ফৌজুল ইমরান খান এবং কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কমিশনার, ফল ব্যবসায়ী সমিতি, বিপিজিএমইএ, রিহ্যাবসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।