‘রাজনৈতিক সহিংসতার বলি থেকে কবে মুক্তি পাবে রাউজান’

2

একসময় সন্ত্রাস ও আতঙ্কের জনপদ হিসেবে বেশ পরিচিতি ছিল চট্টগ্রামের রাউজান ও ফটিকছড়ি। র‌্যাবের উত্থান এবং সন্ত্রাস বিরোধী ক্লিন-হার্ড অভিযানের পর ওই দুটি উপজেলাসহ দেশব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকান্ড কিছুটা লোপ পেয়েছিল। এরপরও রাউজার থেমে থাকেনি। তবে গত প্রায় দেড় দশকে এক অতি প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির একক প্রভুত্ব ও আধিপত্যের কারণে বিরোধী মতের কারও কথা বলার সুযোগ ছিল না বলে সংঘাত ও রক্তপাত কিছুটা কমে আসছিল। গত ৫আগস্ট ২০২৪ এর পর এ এলাকায় একাধিক নেতৃত্বের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবারও সেই আগের অশান্ত রউজান যেন নতুন করে ফিরে এসেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও গুলির শব্দে কাঁপছে চট্টগ্রামের রাউজান। এক সময়ের শান্তিপ্রিয় জনপদটি এখন পরিণত হয়েছে রক্তভেজা সন্ত্রাসের এলাকায়। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে গোলাগুলি, খুন, চাঁদাবাজি, চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে রাউজানের ৬ থেকে ৭ লাখ সাধারণ মানুষ।’ ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৪ মাসে ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই একই দলের রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, যদিও তারা উপদলে বিভক্ত ছিলেন। আছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষও। সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়, এ অল্প সময়ে এত হত্যাকান্ড ও সংঘাতের পরও রাউজানের পুলিশ নির্বিকার! তাদের যেন কিছুই করার নেই। সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের গ্রেফতার কিংবা আইনের আওতায় আনার কোন উদ্যোগও লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে এলাকার মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটছে।
রাউজানের একজন প্রবীণ নাগরিকের সাথে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি জানান, চব্বিশের ৫ আগস্টের পর এ এলাকার অধিবাসীরা আশা করেছিল, রাউজান এবার অবরুদ্ধ থেকে মুক্ত হবে, মানুষ কথা বলতে পারবে, স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করতে পারবে, শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। কিন্তু এসব যেন এখন কল্পনা! রাউজান ফিরে গেছে পুরনো রক্তাক্ত অধ্যায়ে। মুছে যাওয়া সন্ত্রাসী জনপদটি আবারও জেগে উঠেছে সহিংসতার জনপদে। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটিতেই কখনো না কখনো গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে জনপদ।’
আমরা দেখেছি কিছুদিন আগে একজন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাকে তার নিজস্ব গাড়ি করে গ্রাম থেকে শহরে ফেরার সময় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। সবশেষে গত শনিবার বিকেলে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কায়কোবাদ জামে মসজিদের পাশে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন মো. আলমগীর আলম (৫০) নামে এক যুবদল নেতা। যখন লাশ থানায় নিয়ে আসা হয় তখন স্ত্রী ছাড়া লাশের পাশে কেহ ছিলেননা এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাতভর ভাইরাল হতে থাকে। অনেকে লিখেন এইত দুনিয়া। মৃত্যুর আগে অনেক নেতাসমর্থক বন্ধুবান্ধবের লাফালাফি। মৃত্যুর সাথে সাথে সবাই উধাও! একমাত্র স্ত্রী পুলিশ ভ্যানে লাশের পাশে দাঁড়িয়ে হাওমাও করে নীরবে কাঁদছিলেন। এর আগে সবাই একসাথে একটি দাওয়াত খেয়ে ফিরছিলেন সপরিবার। অজ্ঞাত সন্ত্রাসী ৭/৮ জন আলমগীরকে গুলিতে হত্যা করে অটোরিক্সা করে পালিয়ে যায়।
এদিকে কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে সরাসরি দেখা যায় নিহত আলমগীর আগে থেকে তার জীবন বিপন্নের আশঙ্কা করেছিলেন। ভিডিওতে তিনি বলতে শুনা গেছে, আমাকে এরা খুন করতে পারে।কয়েকজনের নাম সেখানে উল্লেখ করেছিলেন।
রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং মরদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার বা পূর্ব বিরোধের জেরেই এ হত্যাকান্ড ঘটেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাউজানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত চলছে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
তবে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার পরিবারগুলোর অভিযোগ, প্রতিটি ঘটনার পর প্রশাসন সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও রাজনৈতিক নেতারা শান্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো হত্যার বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আর নতুন করে ঘটছে হত্যাকান্ড। শিরোনামের কথাটি আমাদের নয়, এটি স্বজনহারা পরিবারের তারা বলেছেন ‘আমরা পরিবর্তন চেয়েছি, কিন্তু এমন পরিবর্তন তো চাইনি, যে পরিবর্তনে রাউজানের মাটি রক্তাক্ত হবে, মানুষ স্বজনহারা হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হবে- এমন রাউজান তো আমরা চাইনি! শোকাহত এক প্রবীনের বুকছাপড়ানো আর্তনাদ ছিল এমন- ‘রাজনৈতিক সহিংসতার বলি থেকে কবে মুক্তি পাবে রাউজান’। আমাদেরও প্রশ্ন কখন রাউজানের মাটি আবার কখন শান্ত হবে? একসময় জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সর্বধর্মের সহ-অবস্থান, সম্প্রীতি ও সুফিবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ রাউজানকে যারা অশান্তির অনলে দগ্ধ করছেন তারা কারা-তাদের চিহ্নিত করা জরুরি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় থেকে সন্ত্রাসী যেই হোক তাদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।