অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব
সংস্কৃতি হলো পরিবেশের সাথে মানুষের সংগ্রামের অভিব্যক্তি বা অভিযোজন। সেই সংগ্রামের অভিব্যক্তির ধারা থেকে আবির্ভাব হলো শিক্ষা। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন,দুনিয়া পরিবর্তনের পথে মোক্ষম অস্ত্র হলো শিক্ষা। আর শিক্ষা হলো সংস্কৃতির দুহিতা। তাই সংস্কৃতিকে সুস্থ রাখতে হয়, ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখতে হয়। সংস্কৃতি থেকে আবির্ভূত সংস্কৃতির বিশেষ ফলিত বা কার্যকরি শাখা শিক্ষাকে তাই অসুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশে গুণগত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যায় না। সুনাগরিক গড়ে উঠবে তাও আশা করা যায় না। তাতে রাজনীতিও সুস্থধারায় থাকতে পারে না, বিকশিত হতে পারে না। সেই সংস্কৃতি মানুষের চিন্তা চেতনাকে ধারণ করে। জীবনযাত্রার পথে নানা ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে যে মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে তা সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই সব দিয়ে সমাজে টিকে থাকা যায়, পরিবেশেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর নিয়ন্ত্রণ করা যায় বলে সে পরিবেশকে কল্যাণকর করা যায়। আবার সেই সংগ্রামের অভিব্যক্তিতে মানুষ নিজে বদলায়। মানুষ বদলায় বলে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পরিবেশও বদলায়। সেই বদলানোর ভেতর দিয়ে গুহা থেকে ও বন্য সমাজ থেকে, সভ্যতায় উঠে আসা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সমাজে সেই সংস্কৃতির মান বা উর্বরতা এতই নিম্নগামী ও কোন কোন ক্ষেত্রে এতই সেই সংস্কৃতি নষ্ট করে ফেলেছি যে সেখান থেকে আর ভাল ফসলের ভাল ফলন হচ্ছে না ও আশা করাও যাচ্ছে না। আকাশচুম্বী ভবন টিকে থাকতে পারে প্রকৌশলীর নকশা, চাহিদার জোগান ও মান সম্মত রড সিমেন্ট ইত্যাদি উপকরণ দক্ষ কারিগরকে দেয়া সম্ভব হলে। যেখানে দায়িত্বশীলতার পরিচয়ও দিতে হয়। তেমনি মানুষের জীবন-জীবিকায় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক সম্পর্কের কারণে গড়ে উঠা জীবনাচার বা সংস্কৃতি গড়ে উঠা নির্ভর করে তার কালের সামাজিক অবস্থার উপর। তাই সংস্কৃতি একদিকে মানবিক সম্পর্ক গড়ায় যেমন ভূমিকা রাখে তেমনি জীবিকাকেও নান্দনিকভাবে অর্থবহ করে তুলে। এই বিবেচনায় বিপরীত জেন্ডারের শুধু যৌন মিলনকে ও যৌন মিলনের প্রক্রিয়াকে কখনও সংস্কৃতি বলা যায় না, তা সাধারণ জৈবিক প্রবৃত্তিমাত্র। কেননা অমানুষ ও পশু শ্রেণিতেও যৌন মিলন ও যৌন মিলনের প্রক্রিয়া থাকে। কিন্তু বিবাহ উৎসব, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা ইত্যাদি সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির ধরণ ও মানের উপর তাই আমাদের জীবনমান নির্ভর করে।
কিন্তু সেই সংস্কৃতিকে আমরা কোথায় কত নিচুতে নামিয়ে নিচ্ছি তা নিয়ে ভাবা জরুরি। জরুরি এই জন্য যে একটি ঘরের পরিবেশ বা জীবন-মান নষ্ট হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা ব্যাপাকাকার হয়ে ক্ষতি করতে পারি না। কিন্তু জলবায়ুর মত যে সংস্কৃতি আমাদেরকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখে তা দূষিত হলে, নষ্ট হলে তখন আর মানুষের ভালো থাকা সম্ভব হয় না, বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। তাই বটবৃক্ষের আশা করলে হয় না। তার সাথে বটবৃক্ষের উপযোগী জল-হাওয়া-মাটি লাগবে। সেই উপযোগী জল-হাওয়া-মাটিই বটবৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তাই মৃত্যুর মুখে পড়া বটবৃক্ষকে দায়ী করে বসে না থেকে সুস্থ মানসিকতায় তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার উপযোগী পরিবেশকে ঠিকঠাক রাখতে হয়। দূষিত করা যাবে না, অন্য কেউ করলে তাকেও বাঁধা দেয়া কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। একটি গোলাপ গাছ যেমন সাধারণ উদ্ভিদের ধর্মকে অবহেলা করে গোলাপ ফুল ফোটাতে পারে না, তেমনি সাধারণ মানুষের নষ্ট করে দেয়া আবেগ অনুভূতির মাঝে বটবৃক্ষের মতো বৃক্ষ-নেতা গড়ে উঠতে পারে না, সেই নেতা টিকে থাকতেও পারে না। আর সেই অপসংস্কৃতির কারণে নেমে আসে রাজনৈতিক বিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ে পড়ার মূল কারণ হলো সুনাগরিক তৈরি করতে না পারা। পচা ফল ভাল ফলের সাথে থাকায় ভাল ফল পচে যাওয়ার মতো দায়িত্বহীন দুর্নীতিবাজদের কারণে ও চাপে ভাল মানুষগুলোও অকার্যকর হয়ে যায়, তাদেরকে আপাতত নষ্ট করে ফেলে বা নষ্ট হতে বাধ্য হয়।
এভাবে দুর্নীতিবাজ নষ্ট মানুষের সমাজে নেমে আসে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ে ঘটে চলে নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পর ঘটনা। তলিয়ে দেখা সম্ভব হয় না পিছনের কার্যকারণ।
অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সামাজিক বন্ধন হয়ে পড়ে দুর্বল। বা সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। দুর্বল বা কাঠামোহীন সমাজে সংস্কৃতি অসুস্থ হয়ে পড়ে। জীবন এগিয়ে নেয়ার শক্তি হলো সংস্কৃতি। অন্যদিকে শক্তিহারা সংস্কৃতি বিকাশের শক্তি আসে তো সমাজ থেকে। সেই সমাজই যদি দুর্বল হয়ে যায় বা ভেঙ্গে পড়ে তাহলে সংস্কৃতি শক্তি পাবে কোথায়। ফলে অপসংস্কৃতি এসে গলা চেপে ধরে। ফসলি মাঠে লবনপানি প্রবেশ করে লবনাক্ততায় ফসল নষ্ট করার মতো সেই অপসংস্কৃতি মেধা-মননের সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেয়, নেমে আসে বিপর্যয়ের থাবা। সেই অপসংস্কৃতির থাবায় তৈরি হওয়া ক্ষত ক্রমে বড় হতে হতে একসময় প্রবল হয়ে উঠে। সেই প্রবলতায় সমাজের গায়ে আব্রæ থাকতে পারে না। সমাজ দিগম্বর হয়ে পড়ে। তাতে মানুষের ভেতরে জমা হতে থাকা রাগ-ক্ষোভ এক সময় ফেটে পড়ে। আর রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়া ও চড়াও হওয়া মানুষরা ই তখন প্লাবনের মত সব কিছু ভাসিয়ে নিতে পারে, নষ্ট করে দিতে পারে। তখন সেই ক্ষুব্ধ মানুষকে আমরা দায়ী করি, ঝুঁকিতে পড়া বটবৃক্ষকে দায়ী করি। মানুষের ভেতরে ক্ষত-ক্ষোভের অপসংস্কৃতির কার্যকারণ তালাশ করতে পারি না। ঝড় টর্নেডো শুরু হয়ে গেলে তো আর সেই ঝড়-টর্নেডো থামানোর জন্য গবেষনা করলে হয় না। থামানোর গবেষণা শুরু করতে হয় অনেক আগ থেকে। যা উন্নত বিশ্বে করে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে করে না। করা সম্ভবও হয় না। প্রথম বিশ্ব বা উন্নত বিশ্বে সেই ঝড় বা টর্নেডো গড়ে না উঠার জন্য বা তৈরি না হওয়ার জন্য চালায় নানা গবেষণা। আবার সেই তৈরি হওয়া টর্নেডো অপ্রতিরোধ্য হলেও সেই ঝড়-টর্নেডোর ক্ষয়-ক্ষতির দিক থেকে অন্যদিকে সেটাকে নিয়ে যাওয়ার নানা কৌশল বা পথ গবেষণা থেকে বাহির করে রাখে। ক্ষয়ক্ষতি থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্য,সমাজ ঝুঁকিতে না পড়ার পথ বাহির করার জন্য সেই সব গবেষনার জন্য তাই প্রচুর অর্থ-শ্রম ব্যয় করা হয়। আমাদের সেই গবেষণা নেই, সেই প্রেক্ষিত তৈরি না হওয়ার গবেষণালব্ধ তথ্য নেই। তার জন্য কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না। বরং ব্যক্তি স্বার্থের জন্য এসব কিছুর প্রতি মনোযোগ দিই নি। তার ফল হিসাবে শুরু হওয়া নানা প্রতিক্রিয়ায় সমাজে বিপর্যয় নেমে আসে। সেই বিপর্যয়ের হাত হতে শিক্ষাও রক্ষা পায় না। শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে গলদ দেখা দেয়। তখন শিক্ষার স্থুল বা গৌণ লক্ষ্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর নিকট মুখ্য বা প্রধান হয়ে উঠে। আর শিক্ষার গৌণ লক্ষ্য আর শিক্ষার গৌণ লক্ষ্য থাকে না। হয়ে উঠে মুখ্যলক্ষ্য। যার ফলে আমরা শিক্ষা অর্জন করি মানুষ হওয়ার জন্য না, শিক্ষা অর্জন করি সনদের জন্য চাকুরির জন্য। মানুষ হওয়া, মানুষ সামাজিক হওয়া যে মূল লক্ষ্য সেই দিকে আর মনোযোগ থাকে না, লক্ষ্য থাকে না। অথচ এই শিক্ষার মূল বা মুখ্য লক্ষ্যই হলো মানুষ তৈরি করা, সুনাগরিক তৈরি করা। পরিচর্যাহীন বাগান ঝোপঝাড়ে পরিণত হওয়ার মতো সুনাগরিক তৈরি না হতে পারায় সমাযে ঝোপঝাড়ের মতো অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়। একসময় সেই ঝোপঝাড়ের যন্ত্রনা সহ্য সীমাকে অতিক্রম করলে তা উপড়ে ফেলতে বাধ্য হয়, পরিষ্কার করতে বাধ্য হয়। তাতে সমাজে ও রাজনীতির সংস্কৃতি দূষিত হওয়ায় মানুষের উপর নেমে আসে বিপর্যয়।
দূষিত সংস্কৃতির বলয়ে মানুষ আটকে পড়ে। মানুষ স্বেচ্ছায় একক চেতনাপ্রবাহে সেই বৃত্ত ভাঙ্গতে পারে না। কারণ সাধারণ মানুষ যুগের সীমানায় নিজের দ্বারা নিজেই বন্দী বা সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো সেই বৃত্তাবদ্ধতার অভ্যন্তরিণ চাপ বেড়ে গেলে তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা। সেই চেষ্টার প্রবল চাপে এক সময় মানুষ দুর্বার হয়ে উঠে। সেই দুর্বার গতির সামনে সমাজের প্রচলিত ধারার সব কিছু তলিয়ে যায়। মানুষ হতাহত হয়, জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়। দুষ্টচক্রের মতো মত এখানে বার বার ঘুরপাক খেয়ে চলে। চূড়ান্ত মুক্তি আসে না। সেই শোষণ নির্যাতনের চূড়ান্ত মুক্তি কখন আসবে, কিভাবে আসবে, কাদের দ্বারা আসবে এই প্রশ্ন জাগানো জরুরি। তার জন্য আগে চাই অপসংস্কৃতির বৃত্ত ভেঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার বিপ্লব। যে বিপ্লবে সাধারণ মানুষের চেতনাপ্রবাহ যুক্ত হয়ে বিপ্লবের ধারাকে খরতর করে তুলবে। আর তা সম্ভব হলে মানুষ সুনাগরিক হয়ে দায়িত্বশীল হওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আর তাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। তবে চিন্তার বিষয় হলো এই যে সংস্কৃতির বিপর্যয় বা অপসংস্কৃতি দূর করা অত কি সহজ। দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার, সাধনার ব্যাপার। সেই ধৈর্য ও সাধনার ক্ষমতা আমাদের কি আছে। আছে কি নাই, তা ভাবা অবান্তর। শুরু তো করতে পারি। আসুন শুরু করি, দেশটা তো আমাদের।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট