নিজস্ব প্রতিবেদক
রাউজানে সাম্প্রতিক খুনখারাবির পেছনে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং মাটি-বালু ব্যবসা ও চাঁদাবাজিকে দায়ী করেছেন উত্তর জেলা বিএনপির আহব্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকার। তিনি দাবি করেন, মাটি কাটা, বালুমহাল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্যের মতো অনৈতিক কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করেই রাউজানে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে; একের পর এক হত্যাকান্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
গতকাল শনিবার নগরীর কাজীর দেউড়ির নাসিমন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে উত্তর জেলা বিএনপির আহব্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, রাউজানে খুনখারাবির ইতিহাস নতুন নয়। ১৯৮৫ সালে কলেজছাত্র ফারুক হত্যার মধ্য দিয়ে এ জনপদে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। তখন ছাত্রলীগ ও অধুনালুপ্ত এনডিপির সন্ত্রাসীরা এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত শতাধিক ছাত্র-যুবক প্রাণ হারিয়েছেন। এটি কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বর ফল নয়, বরং সন্ত্রাস ও দখলবাজির ফল। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর রাউজানে হত্যাকান্ডের নতুন ঢেউ শুরু হয়েছে। এগুলোর মূল কারণ হলো মাটি কাটা, বৈধ-অবৈধ বালুমহাল দখল, সরকারি দপ্তরের ঠিকাদারি প্রকল্প থেকে কমিশন আদায়, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায়। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-আগুন লাগানোর মতো ঘটনা ঘটছে।
গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, বর্তমানে সন্ত্রাসীরা নিজেদের অপরাধ ঢাকতে বিএনপির নাম ব্যবহার করছে। অথচ আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে থেকেছি। অসংখ্য মামলা হয়েছে, জেল-জুলুম সহ্য করেছি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয়ে কোনো অপরাধীকে আড়াল করা বা সন্ত্রাসীদের পাশে বসিয়ে রাখা উচিত নয়। প্রকৃত নেতা কখনো সন্ত্রাসী হতে পারে না। তিনি বলেন, ঘটনার পর দেখা যায়, কাদের নামে মামলা দিলে টাকা আদায় করা যাবে, এ জন্য মামলা দেয়ার আগে পরিকল্পনা করা হয়। রাউজানের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডগুলোতে আসামি বানানো নিয়েও টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে। কেউ অপরাধ করলে সে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক জানতে চান, রাউজানে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার সঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী জড়িত কিনা। জবাবে গোলাম আকবর কৌশলে উত্তর দিয়ে বলেন, আমি দলের দায়িত্বে আছি। যারা নিহত হয়েছে ও হত্যায় জড়িত, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে কারা প্রকৃতপক্ষে জড়িত। তিনি বলেন, রাউজানে থানা ও উপজেলা প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। থানায় গিয়ে দেখা যায়, এক পক্ষ সবসময় অবস্থান নেয়। যারা ৫ আগস্ট থানা হামলা করে অস্ত্র লুট করেছিল, তারাও এখন থানায় গিয়ে বসে থাকে। সাধারণ মানুষ থানায় গিয়ে ন্যায়বিচার পায় না।
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, কিছুদিন আগে জেলা যুবদলের সভাপতির নেতৃত্বে ১৫ জন উপজেলা প্রশাসনে যান কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানে তাদের ওপর হামলা হয় এবং বলা হয়, তাদের সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই। এটা নেতাদের নির্দেশে হয়েছে।
রাউজানের ইটভাটা ও গাছের ট্রাক থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগও তোলেন গোলাম আকবর খোন্দকার। তিনি বলেন, প্রতিদিন রাঙামাটি-কাপ্তাই এলাকা থেকে ৫০টি ট্রাক গাছ আসে। সেখান থেকে নিয়মিত টাকা আদায় করা হয়। রাউজানে ৩৮টি ইটভাটা আছে। গত নভেম্বরে প্রতিটি ইটভাটা থেকে তিন লাখ টাকা করে ধার্য করা হয়, যার মধ্যে দুই লাখ টাকা করে উত্তোলন করা হয়েছে। ঈদের আগে এক লাখ টাকা করে আলাদা চাঁদা তোলা হয়েছে। এসব টাকা কারা তুলেছে তা ইটভাটায় গেলে সহজেই জানা যাবে।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, আমি যদি এসবের সঙ্গে জড়িত থাকি, প্রমাণ করুন। কিন্তু মনগড়া কথা বলে দলের অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।
সংবাদ সম্মেলনে উত্তর জেলার সিনিয়র যুগ্ম আহব্বায়ক এম এ হালিম, যুগ্ম আহব্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস চৌধুরী, কাজী সালাউদ্দিন, নুরুল আমিন, ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন, ফটিকছড়ি উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আজিমুল্লাহ বাহার, রাউজান বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক জসিম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি কুতুব উদ্দিন বাহার, স›দ্বীপের অ্যাডভোকেট এম এ তাহেরসহ বিএনপি ও যুবদলের বিভিন্ন নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট রাউজানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। দীর্ঘদিন প্রভাব বিস্তার করা আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর আধিপত্যের অবসান ঘটে। এরপর থেকেই রাউজান অশান্ত হয়ে ওঠে। প্রতিদিন রক্তাক্ত ঘটনা ঘটছে। বিএনপির অভ্যন্তরীণ দলাদলি ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দ্ব›দ্ব মিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ তুলছে, যদিও প্রকাশ্যে কেউই দায় স্বীকার করছে না। এমন পরিস্থিতিতে উত্তর জেলা বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে স্পষ্ট করল, রাউজানে হত্যাকান্ডের দায় বিএনপির কোনো নেতার নয়; বরং স্থানীয় অপরাধ চক্র এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে।