
কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূচনা হলেও ধীরে ধীরে তা পুরোনো বৃত্তে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের বিরোধ তীব্র হচ্ছে। একে অপরের বিরুদ্ধে নানা বিষেদগার করে যাচ্ছে, ফেসবুকে কথার তীর ছুঁড়ছে। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছে উভয়পক্ষ। থেমে নেই উভয় দলের অনলাইন যোদ্ধারাও ! যদিও পুরোনো বয়ান নিয়ে হাজির হচ্ছেন কেউ কেউ। অথচ সেই একই বয়ানের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীরা। এগুলো টেনে আনলে রাজনীতিতে কখনো ঐক্য কিংবা সম্প্রীতি গড়ে উঠবেনা। বাড়বে প্রতিহিংসা, অসহিষ্ণুতা। যা কারও জন্য ভালো ফল বয়ে আনবেনা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর অনৈক্যের কারণে আমাদের দেশটা সামনে এগুতে পারছেনা। ভুলত্রæটি থাকবে, মতবিরোধ থাকবে। সেসবকে প্রাধান্য না দিয়ে সবাই মিলে কীভাবে দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই চিন্তা করতে হবে রাজনীতিবিদদের। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এত মানুষের প্রাণদানকে বৃথা যেতে না দিতে হলে যেকোন মূল্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে। পারস্পরিক সমঝোতা, সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হবে।
বিএনপি-জামায়াত সেই ’৯১ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৩৪ বছর একসাথে সরকার গঠন, আন্দোলন করে এসেছে। যে কারণে একে অপরের বিরুদ্ধে করা এসব আলোচনা-সমালোচনা সাধারন মানুষ সেভাবে গ্রহণ করবেনা। মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে বলেও মনে হয়না। তারা চায় দুই বড় দলসহ সব রাজনৈতিক দল মিলেমিশে থেকে দেশ পরিচালনা করুক। বিরোধিতা, প্রতিহিংসা কাউকে স্বস্তিতে থাকতে দেবেনা। বরং দেশকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিবে।
রাজনীতি তো সাধারন মানুষের জন্য। সেখানে দলগুলোতে বিরোধ, বিতর্ক থাকলেও দেশকে নিয়ে যেন কোন ষড়যন্ত্র না হয়। কিংবা ক্ষমতার লোভে পড়ে যেন কারো ষড়যন্ত্র সফল না করে! মানুষের জন্য দেশের জন্য কাজ করাই একটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য। কীভাবে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কর্মসূচি প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন করা যায় সেই চিন্তা করতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের। সেই মূল এজেন্ডা বাদ দিয়ে নিজেদের আখের গোছানোতে দেশের মানুষের লাভ তো হবেইনা উপরন্তু নানা সংকটে জর্জরিত হতে হবে।
আমাদের দেশটা অপার সম্ভাবনার। এখানে একটি দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ করার সবধরনের উপাদান, সম্পদ বিদ্যমান। শুধু সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সৎ ও সততার মানদন্ডে উত্তীর্ণ কিছু মানুষের কিছু নেতার প্রয়োজন যারা এসব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে পারবেন। আমি জানি রাজনীতিবিদদের সে যোগ্যতা রয়েছে। এখন শুধু দরকার নির্লোভ আর নিরহংকার মনোভাব নিয়ে ঐক্যের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সাধারন মানুষের মন ও মননে পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বিশেষ করে ভোট দিতে না পারা কিংবা নতুন কোটি কোটি তরুণ ভোটার কিন্তু এবার মার্কা বা দল দেখে ভোট দেবেন- সে আশা করা বোকামি হবে! যার প্রতিফলন ইতিমধ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে। অর্থাৎ কেবল নেতা আর মার্কা নয় বরং সেই নেতা ও তার দলের কর্মসূচি, কার্যক্রম, আচার-ব্যবহার এমনকি চলনেবলনে নেতার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন তরুণ ভোটাররা যা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সুতরাং সাধু সাবধান!
আমাদের দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর গতানুগতিক মনোভাবটা হলো ক্ষমতায় যেতে পারলে মানুষের জন্য কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে, ক্ষমতাহীন থাকলে নয়। অথচ ক্ষমতায় যেতে পারি না পারি মানুষের জন্য যে কাজ করতে হবে সে কথাটা বেমালুম ভুলে যাওয়া যেন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে রাজনীতিতে।
পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সংষ্কারও জরুরি। বর্তমান বিদ্যমান বাস্তবতায় বিএনপি, জামায়াত ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে তাদেরকেও। আগের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। দলের সব পর্যায়ে নেতৃত্ব ঠিক করতে ভোটাভুটির প্রচলন করতে হবে। পরিবারতন্ত্রের পথে না হেঁটে সৎ, নির্লোভ ও সাহসী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নজর দিতে হবে। সব ধরনের ফ্যাসিজমের বিলোপ সাধন করতে হবে। দলের তৃণমূল পর্যায়ে যদিও নজর দেওয়া কঠিন সেহেতু অন্যায়, অনিয়মের প্রমাণ মিললে তাৎক্ষণিকভাবে দলীয় ব্যবস্থা প্রয়োজনে অপরাধের সাথে জড়িতদের আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে, ছাড় দেওয়া যাবেনা কোনভাবে। ক্ষমতায় গেলে সরকারের মন্ত্রী বা সরকারি অন্য কোন দায়িত্বে থাকলে দলীয় পদ-পদবি গ্রহণ না করার মানসিকতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। নেতাকর্মীদের মাঝে সততা ও ন্যায়ের গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। দলীয় গঠনতন্ত্রকে দেশের উন্নয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা, ধর্মীয় ও নৈতিকতার বিষয়ে ধারা সংযুক্তসহ যুগোপযোগী করতে হবে। দেশের সাধারন মানুষের চাওয়া, পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে।
সব রাজনৈতিক দলকে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দলে বা সরকারে কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাবেনা, শাস্তি পেতেই হবে- এমন বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করতে হবে। অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িতদের ব্যাপারে কোন রকম সহানুভ‚তি দেখানো যাবেনা বা আপোষ করার কোন সুযোগ রাখা যাবেনা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার, নিরপেক্ষ নির্বাচনে সকলের নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রদানসহ সব অধিকার যথাযথ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি যেন আর কখনো না হয়, আর কখনো যেন ফিরে না আসে।
আমরা চাই রাজনীতিতে সুদৃঢ় ঐক্য হোক, ভেংগে যাক বিভেদের সব দেয়াল। জনগণের কাছে গিয়ে তাদের সুখ-দুখের ভাগীদার হয়ে তাদের জন্য কাজ করে একটি সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট











