নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
দেশে একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এই হাওয়া চট্টগ্রামের রাজনীতিকে ভবিষ্যতে কোন দিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে সেটাই বুঝার চেষ্টা করব। আমরা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। কারণ আমরা আদার বেপারী, জাহাজের খবর নিয়ে আমাদের লাভ কি। সম্ভবত বাষ্পীয় পোত চলাচলের সময় এই প্রবাদের জন্ম হয়নি। তখন আদা আসতো নৌকা-সাম্পানে করে। অবশ্য আজ-কাল আদাও ব্যবসায়ীরা জাহাজ চার্টার করে বিদেশ থেকে আমদানি করে। ফলে আদার বেপারিদেরকেও এখন জাহাজের খবর রাখতে হয়।
যাই হোক আগামী দিনে চট্টগ্রামের রাজনীতির চালকের আসনে কে বা কারা বসবেন, সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলতে পারে, কিন্তু স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। আওয়ামী লীগের স্টার প্লেয়ার এমএ মান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, আখতারুজ্জামান বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ইতিমধ্যে পটল তুলেছেন। আর আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে বলেও মনে হয় না। বিএনপি’র স্টার প্লেয়ার ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান, কর্নেল অলি আহমদ, মোর্শেদ খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, গোলাম আকবর খোন্দকার, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম। অলি আহমদ বিএনপি থেকে বেরিয়ে নিজে আলাদা দল করেছেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম পরলোকে চলে গেছেন। মাঠে আছেন বা মাঠে নামতে পারবেন নোমান, খসরু, খোন্দকার। তারকা খেলোয়াড়ের স্বল্পতার কারণে জার্সি গায়ে উঠতে পারে ডা. শাহাদাত হোসেন, আসলাম চৌধুরী ও এরশাদ উল্লাহর।
জামায়াতের তারকা খেলোয়াড় বলতে তিন চার জনকে বোঝানো যেত, তাঁরা হলেনÑঅধ্যক্ষ মওলানা আবু তাহের, আফসার উদ্দিন চৌধুরী, শাহজাহান চৌধুরী ও মওলানা শামসুল ইসলাম। অধ্যক্ষ তাহের অক্কা পেয়েছেন, বাকি তিনজন আছেন। আমার এই লেখা দিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতির উপর নতুন একটি সিরিজ আরম্ভ হচ্ছে। আজ তার প্রথম কিস্তিতে প্রকাশ করা হলো।
বালাগাত উল্লাহ:
প্রাক্তন ছাত্র ও যুবনেতা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ মিরসরাই থানার গাছবাড়িয়া গ্রামে জানু মুহুরী বাড়িতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জন্মগ্রহণ করেন।
বালাগাত উল্লাহ’র পিতা মওলানা আবুল হোসেন। পিতা একজন বিখ্যাত আলেম। তারা চার ভাই দুই বোন।
পঞ্চাশের দশকে নিজ এলাকায় অবস্থিত নিজামপুর মুসলিম হাই স্কুল সংলগ্ন (একই ক্যাম্পাসে) মির্জা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাসের পর মির্জাবাজার ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে দাখিল পাস করেন এবং চট্টগ্রাম শহরে এসে ছোবহানিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ওই মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেন (তখন ফাজিল এসএসসি সমমান ছিল বর্তমানে বিএ সমমান) মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজে বিএ (পাস) ভর্তি হন। শেষ বর্ষে ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে এবং পরিবর্ধিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর অগ্রসর হয়নি। পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। গ্রেফতারি পরোয়ানা, তার উপর অস্ত্র মামলায় প্রায় চার বছর আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক-রাজনৈতিক কাজ করতে হয়েছে।
বালাগাত উল্লাহ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সদস্য (১৯৬৮-৬৯) চট্টগ্রাম নগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (’৬৯-’৭০) জেলা কমিটির প্রচার সম্পাদক (’৭০-’৭১) ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ’৭১ খ্রিস্টাব্দে আগরতলায় অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টির তাকে সদস্যপদ প্রদান করে। এর আগে ’৬৮ সাল থেকে পার্টির জেলা ছাত্র সেলের সদস্য ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম নগর কমিটির প্রথম সভাপতি (’৭২-’৭৩)। জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক (’৭৩-’৭৮) জেলা কমিটির সভাপতি (’৭৮-’৭৯)।
বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন চট্টগ্রাম মহানগর সাধারণ সম্পাদক (’৮০-’৮১) সভাপতি (’৮১-’৮২) জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক (’৮২-’৮৩) সভাপতি (’৮৩-’৮৪) একই সময় কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি। উল্লেখ্য, গণসংগঠনের দায়িত্ব পালনকালে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্ক গোপন রাখা হত। যুব ইউনিয়ন থেকে বিদায়ের পর প্রথম প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টির কাজে যোগদান করেন। তাঁকে পতেঙ্গা এলাকায় পার্টির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সদস্য (’৮৫-’৮৬) সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য (’৮৬-’৯০ দুইবার) জেলা কমিটির সদস্য (’৯০-’৯১) জেলা কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য (সাংগঠনিক ’৯২-’৯৩) সর্বশেষ জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক (’৯৩-’৯৪)। এরপর সার্বক্ষণিক রাজনীতি থেকে সরে আসেন। তবে বর্তমানেও তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদ বহাল রয়েছে।
আলহাজ আফসার উদ্দিন চৌধুরী :
আফসার উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগরের একটি সুপরিচিত নাম। চট্টগ্রাম মহানগরের তাঁর জন্ম, মহানগরেই বেড়ে ওঠা এবং মহানগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া; অধ্যয়ন যখন শেষ হলো, তখনও কর্মক্ষেত্র হিসেবে তাঁর প্রিয় নগরকেই বেছে নিয়ে কখনো ব্যবসা, কখনো সাংবাদিকতার পরিমÐলে জীবনের ৭৩টি বছর কাটিয়ে ফেলেছেন। এর মধ্যে যেটা বলা হয়নি, সেটা হলো তিনি আগাগোড়া একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবনেই রাজনীতি আরম্ভ করেন এবং তারপর রাষ্ট্র ভাঙ্গাগড়া এবং সরকার উঠানামার মধ্যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন আফসারউদ্দিন চৌধুরী।
তাঁর জন্ম একটি রাজনৈতিক পরিবারে, যে পরিবারের প্রায় সকল পুরুষ সদস্যই কখনও না কখনও রাজনীতিতে জড়িত হয়েগেছেন। তাঁর পিতা এ কে এম নওশা চৌধুরী, নিজেও একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন। রাউজান থানার মধ্যম কলদপুরের মানুষ হলেও তিনি চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটায় বাড়ি তৈরি করে সেখানেই বসবাস করতেন। তিনি নিজের বীমাবিদ, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্সুরেন্স কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার ছিলেন। সেই সময়ের মানুষ তিনি, যখন মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনে ভেসে গিয়েছিলেন। নওশা চৌধুরীও চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও তিনি মুসলিম লীগই করতেন।
আফসার উদ্দিন চৌধুরীরা ৪ ভাই, ৩ বোন। বড় ভাই আনসার উদ্দিন চৌধুরী-গ্র্যাজুয়েট, ব্যাংকার ছিলেন। ২য় মনসুর উদ্দিন চৌধুরী, তিনিও গ্র্যাজুয়েট, ব্যবসা করতেন। এরপর আফসার উদ্দিন চৌধুরী, ভাইদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। চতুর্থ খুরশিদ আনোয়ার চৌধুরী, এমএ পাস, চাকরিজীবী।
৩ বোনের মধ্যে ১ম বোন আঞ্জুমান আখতার চৌধুরী, ইন্টার পাস। তাঁর স্বামী কামালউদ্দিন আহমদ-এমএ পাস। ২য় বোন মনোয়ারা আখতার, ইন্টার পাস। তাঁর স্বামী বদিউল আলম দোভাষ, এয়াকুব নগর। ৩য় বোন নার্গিস আখতার-গ্র্যাজুয়েট, তাঁর স্বামী মোহাব্বত খান-চান্দগাঁও নিবাসী।
আফসার উদ্দিন চৌধুরী জেএমসেন হাইস্কুলে ১ম থেকে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর পঞ্চম শ্রেণিতে চলে যান মুসলিম হাইস্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে এসএসসি পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজ থেকে এবং ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আইকম পাস করেন। ডিগ্রি পাস করেন একই কলেজ থেকে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এরপর তিনি চার্টার্ড একান্ট্যাসি পরেন এসএফ রহমানের এন্ড কোম্পানি থেকে। এ সময় তিনি চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ছাত্র পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। কমার্স কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। তাঁকে কমার্স কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরে ১৯৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘ চট্টগ্রাম শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমার্স কলেজে অধ্যয়নকালে তার সমসাময়িক ছাত্রনেতা ছিলেন-ছাত্রলীগের মোছলেম উদ্দিন আহমদ, এমএ হাশেম ও ফসিউদ্দিন। ফসিউদ্দিন পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন।
জনাব আফসার উদ্দিন ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী ফতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র সংঘের কর্মিদের সাথে অংশগ্রহণ করেন।
জনাব আফসার উদ্দিন ১৯৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি দলের সহকারী সম্পাদক এবং সর্বশেষ নায়েবে আমীর ছিলেন। আফসার উদ্দিন চৌধুরী দৈনিক কর্ণফুলীর সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি চট্টগ্রাম প্রেস মালিক সমিতি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৪ বছর উক্ত দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি ইসলামি সমাজ কল্যাণ পরিষদের সহ-সভাপতি, জমিয়তুল ফালাহ মসল্লি পরিষদের সহ সভাপতি ও সিডিএ’র বোর্ড মেম্বার ছিলেন।
আফসার উদ্দিন চকরিয়া থানার ঢেমুশিয়ার বিখ্যাত জমিদার ফয়েজ আহমদ চৌধুরীর কন্যা রোকসান আলম চৌধুরীর পাণিগ্রহণ করেন। তাঁর দুই পুত্র ও এক কন্যা। বড় কন্যা, তাঁর নাম দিলশাদ চৌধুরী, তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী, স্বামী আসফদ্দৌলা, হালিশহর নিবাসী। পুত্র রায়হান, মাস্টার্স-ব্যাংকার; অপর পুত্র ইমরান চৌধুরী, মাস্টার্স-ব্যবসায়ী।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা