রাঙামাটিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের টর্চার সেলের সন্ধান

1

রাঙামাটি প্রতিনিধি

রাঙামাটিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের টর্চার সেলের খোঁজ মিলেছে। কথিত আয়না ঘর বা টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে ব্যবসায়ী, শ্রমিক থেকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতো, আর চাঁদা না দিলে চলতো অমানসিক নির্যাতন। এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা ছাত্রলীগের এসব চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের সদস্যদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল রবিবার খোঁজ মেলা টর্চার সেলটি রাঙামাটির প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত আলম ডকইয়ার্ডের প্রবেশ পথের সাবা টাওয়ারের নিচতলায়।
তবে পুলিশ বলছে, সুনির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে রাঙামাটি শহরের আলম ডকইয়ার্ড এলাকায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসহ মানুষদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিতে অতিষ্ট থাকতো এলাকাবাসী। তৎকালিন সময়ে তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইতেন না। অভিযোগ রয়েছে- জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি পিকআপ চালক হাবিবুর রহমান বাপ্পীর নেতৃত্বে জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন কায়সার (বর্তমানে কারাগারে বন্দী) ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ রাব্বী ও মোহাম্মদ রাকিব চাঁদা আদায়ে অমানসিক নির্যাতন চালাতো। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাওয়াল উদ্দিনের দিকনির্দেশনায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও চাঁদাবাজি করতো তারা। বর্তমানে শাওয়াল উদ্দিনও পলাতক আছেন।
রাঙামাটি শহরের আলম ডকইয়ার্ড এলাকায় ৬ তলা সাবা টাওয়ারের নিচতলায় একটি কক্ষে টর্চার সেল বানিয়ে ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীরা স্থানীয় ব্যবসায়ী, ভবন মালিক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতো। চাঁদা না দিলে কথিত টর্চার ঘরে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন চালাতো তারা। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকতো। যারা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতেন তাদেরকেও প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি-ধমকি দিতো। শুধু চাঁদাবাজি নয়; তারা স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের ইভটিজিং, প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি, গ্যাংদের নিয়ে আড্ডাবাজি, সীমান্ত পথ ব্যবহার করে ভারতীয় সিগারেট বিক্রিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। তবে বর্তমানে তারা পলাতক রয়েছেন। এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীরা নিষিদ্ধ এ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
টর্চার সেলের বর্ণনা দিয়ে ভ্যান চালক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি মাশরুম কেরিং করি। ছাত্রলীগ নেতা মো. রাব্বী, হাবিবুর রহমান ও মো. রাকিবসহ আরো কয়েকজন মিলে আমাকে টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাকে মারধর করে এবং ৪ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। অন্যথায় আমি রাঙামাটি শহরে থাকতে পারবো না। পরে আমি নিরুপায় হয়ে নিজ বাড়ি বাঘাইছড়ি থেকে জমি বিক্রি করে তাদেরকে চাঁদার টাকা পরিশোধ করি। এসবের নেতৃত্বে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাওয়াল উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন।
মুদি দোকানি আব্দুল হক ও বাড়ির মালিক বদিউল আলম বলেন, আমি সাধারণ একজন মুদি দোকানদার হয়েও প্রতিনিয়ত চাঁদা দিতে হতো ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের। যার কারনে ২০২৪ সালের শেষের দিকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। বদিউল আলম বদি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা যখন পাকা ভবন তৈরি করি তখন এই সব ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা আমাদের কাছে চাঁদা চায় কিন্তু আমরা চাঁদা দিতে অপারগতা জানালে আমাদের সামান্য জমি তারা কেড়ে নিয়ে যায়। তৎকালিন সময়ে আমরা কোথায়ও বিচার পাইনি। এখন সুযোগ এসেছে বিচার চাওয়ার তাই আমরা এসব চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি আহŸান জানাই। এসব চাঁদাবাজরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাওয়াল উদ্দিনের নেতৃত্বে চাঁদাবাজির কাজ করতেন।
স্থানীয় ভবন মালিক আব্দুল করিম ও কলিমুল্লাহ বলেন, ২০২৪ সালে আমি নতুন ভবন নির্মাণ করার সময় আমার শ্রমিকদের তুলি নিয়ে যায় ছাত্রলীগের চাঁদাবাজরা। পরে আমার শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে তাদের কাছ থেকে মোবাইলসহ টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরে আমার কাছে ৩ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে আনোয়ার হোসেন কায়সার গংরা।
আলম ডকইয়ার্ড এলাকার সমাজ উন্নয়ন কমিটির সদস্য জয়নাল আবেদীন ঝুনু ও কামাল হোসেন বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ বিগত দিনে আলম ডকইয়ার্ডের ওই ভবনে নারকীয় কর্মকান্ড চালিয়েছে। যা আপনাদেরকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এসব ছাত্রলীগ নামধারীদের কাজ ছিল কিভাবে চাঁদাবাজি করবে। রীতিমত তারা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে ফেলেছিল। কেউ কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছিল না। আমরা তাদের অপকর্মের সুষ্ঠু বিচারসহ গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।
সাবা টাওয়ারের মালিকের শ্বশুর আব্দুল মান্নান কোম্পানী বলেন, আমি এই ভবন নির্মাণ করতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ধাপে ধাপে প্রায় ১০ লক্ষ চাঁদা দিতে হয়েছে। কারন চাঁদা না দিলে তারা আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা এভাবে অনেক জনের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেছে। তৎকালিন সময়ে বিচার দেওয়ার জায়গা ছিল না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী ছাত্রলীগের কব্জায়।
স্থানীয় সচেতন মহল বলেন, আমরা শুধু আলম ডকইয়ার্ডের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কথা শুনে অবাক হলাম। গোটা রাঙামাটিতে যে সকল চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করেছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। জেলার ১০ উপজেলায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লোকজন সীমাহীন চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, চাকরি বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্বিক) মারুফ আহম্মেদ বলেন, দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য বিশেষ অভিযান চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাঙামাটিতেও বিশেষ অভিযান চলমান অবস্থায় বিভিন্ন আসামি গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যেন এসব সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা এলাকায় ত্রাস ও অশান্তি সৃষ্টি করতে না পারে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।