
কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামের রাংগুনিয়া উপজেলায় পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। উপজেলার চন্দ্রঘোনা, পারুয়া, পোমরা, শান্তিনিকতন, মুরাদনগরসহ বেশকিছু ইউনিয়নে পুকুরে ডুবে অনেক শিশু মারা গেছে। পুকুরে ডুবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাঁচ শিশুর মৃত্যু হয়েছে রাংগুনিয়া উপজেলায়।
তথ্যমতে, রোববার (২৬ অক্টোবর) রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা এলাকায় মো. ইয়াছিন (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। আর আগে শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের উত্তর পারুয়ার দক্ষিণ পাড়া গ্রামে সুমাইয়া আক্তার (১১), রুবিনা পারভীন হাবিবা (৭) ও জান্নাত আক্তার (১০) নামে একসঙ্গে তিন শিশুর মৃত্যু হয়।
সর্বশেষ, বুধবার (২৯ অক্টোবর) বুধবার সম্পূর্ণা সাহা মিমি নামের এক স্কুল ছাত্রী পুকুরে ডুবে মারা যায়। ঐদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড মহাজন বাড়ি এলাকার পুকুরে এই ঘটনা ঘটে।
নিহত শিশুর নাম সম্পূর্ণা সাহা মিমি (৯)। সে পার্শ্ববর্তী চার নম্বর ওয়ার্ড সুশীল ডাক্তার বাড়ির গার্মেন্টসকর্মী লিটন সাহার মেয়ে। সাবেক রাঙ্গুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ছিলো সে। তার মা সুমি সাহাও একই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন বলে জানা গেছে।
নিহত শিশুর চাচা সৌরভ সাহা জানান, কয়েকদিন আগে মায়ের সাথে সে মামার বাড়ি বেড়াতে যায়। স্কুল শিক্ষিকা মায়ের সাথেই সে প্রতিদিন স্কুলে আসা-যাওয়া করতো। তবে বুধবার তার মা আগেই স্কুলে চলে গিয়েছিলো। অন্যদিকে ছোট্ট মিমি নিজেই বরাবরের ন্যায় পুকুরে গোসলে নেমে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সে পুকুর পাড়ে বসে মগের সাহায্যে গোসল করে। সম্ভবত সে গোসলে নেমে সবার অগোচরে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেনি। পরে পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া টিংকু সাহা নামে এক পথচারী তার নিথর দেহ ভেসে থাকতে প্রথমে দেখেন। সবাই তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরিবারে এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে ছোট সন্তান ছিলো বলে জানান তিনি। এর আগেও বিভিন্ন সময় পুকুরে ডুবে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। একের পর এক পুকুরডুবিতে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় মা-বাবা, অভিভাবকদের মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা নানার বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ঘটছে!
পুকুর ডুবির ঘটনা রোধে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অনেকসময় মা, বাবা, অভিভাবকের খামখেয়ালিপনার কারণে নিকটস্থ পুকুরে ডুবে পরিবারের ছোট সদস্যের (শিশু) মৃত্যুর ঘটনা অনেক। সাঁতার শেখাতে গিয়ে অথবা পুকুরে হঠাৎ তলিয়ে গিয়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। দুপুরের নির্জন সময়টা সবচেয়ে ভয়ের। এসময় পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়ে বা কাজে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে শিশু সন্তানদের কথা ভুলে যাওয়ার কারণে; কাছের পুকুরে সন্তানের মৃত্যু দেখতে হয় যা খুবই মর্মান্তিক। এজন্য সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাঁতার জানা। সাঁতার শেখাতে রাংগুনিয়ায় সইমিং পুলের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলছেন অনেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১ থেকে ৯ বছরের শিশুর মৃত্যুর অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে যাওয়া। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত জলাধারে এবং দিনের প্রথম ভাগে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। গ্রামাঞ্চলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার এই হার শহরের চেয়ে বেশি। এর সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, গ্রামে পুকুর এবং ডোবার মতো ছোট ছোট জলাধারের সংখ্যা বেশি।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে আসে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং তা হ্রাসের হার শতকরা ৮৮ ভাগের বেশি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকরী বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশু যতেœর সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা–বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুকুরে ডুবে মৃত্যু রোধে সাঁতার শেখানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ৩ থেকে ৫ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে বেশি মারা যায়। ওই বয়সী শিশুদের তো সাঁতার শেখানো সম্ভব না। এর চেয়ে কম বয়সীও যারা আছে, তারা হামাগুড়ি দিয়ে পুকুরে চলে যেতে পারে। তাই আমরা পুকুরে বেষ্টনী দিতে উৎসাহিত করি। শিশু হামাগুড়ি দেওয়া শিখলে অভিভাবক তাদের বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারে। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না। হয়ত এটা বাস্তবায়ন কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তাই আমাদের বার্তা হচ্ছে, সাঁতারের পাশাপাশি পুকুরে যেন ঘেরা দেওয়া হয়।
তবে সবচেয়ে বড় কথা সচেতনতা তৈরি করা। সচেতনতাই পারে পুকুর ডুবি থেকে অনেকাংশ রক্ষা করতে। তাই আসুন, পরিবার ও সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সাঁতার শেখার মাধ্যমে পুকুরে ডুবে মৃত্যু থেকে বাঁচার চেষ্টা করি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট











