মো. দিদারুল আলম
প্রতিবছর রমজান মাসকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীদের মুনাফালোভী মনমানসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দেশে বর্তমানে সরবরাহ সংকট না থাকলেও কিছু অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ রমজানকে সামনে রেখে বাড়তি মুনাফা পেতে নিত্যপ্রয়েজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। যেমন তেল আমদানি নিয়ে সংকট না থাকলেও তেল নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। চালের দামও বাড়তি। কোনো অবস্থাতেই চালের দাম কমানো যাচ্ছে না। চাল আমদানির সুযোগ ও শুল্ক কমানো হলেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। চাল আমদানি ততটা বাড়ছে না। ভরা মৌসুমেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে রোজায় বাজারে ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে প্রায় তিন লাখ টন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসের প্রথম ২৯ দিনে সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে প্রায় চার লাখ টন। আবার সয়াবিন তেল তৈরির কাঁচামাল সয়াবিনবীজ আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন। এই বীজ মাড়াই করে পাওয়া যাবে প্রায় অর্ধলাখ টন সয়াবিন তেল, অর্থাৎ রোজার চাহিদার চেয়ে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকবে। রোজায় চিনির চাহিদাও তিন লাখ টনের মতো। বিগত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে জানুয়ারি মাসে, ১ লাখ ৫৩ হাজার টন। বন্দরে এসে ভিড়েছে আরও প্রায় এক লাখ টন চিনিসহ জাহাজ। ফেব্রæয়ারি মাসেও চিনি আমদানি হবে। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমছে। কিন্তু এতকিছুর পরও চিনির দাম কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
রোজায় এক লাখ টনের মতো ছোলার চাহিদা রয়েছে। জানুয়ারিতে ছোলা আমদানি হয়েছে ৯৩ হাজার টন। ডিসেম্বরে এসেছিল আরও ১৫ হাজার টন। এক লাখ টন চাহিদার বিপরীতে জানুয়ারিতে মসুর ডাল এসেছে ৬২ হাজার টন। রোজায় মটর ডালের চাহিদাও বেশি থাকে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, রোজায় এক লাখ টন মটর ডালের চাহিদা রয়েছে। জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার টন। বছরের পর বছর চলছে ব্যবসায়ীদের দ্রব্যের দাম বাড়ানোর অপকৌশল। আর এর মাধ্যমে ওইসব ব্যবসায়ী প্রতিবছর নিরীহ ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার কোটি টাকা। এবারও সেই চক্রটি একই কৌশল অনুসরণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে-অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কখনও রোজা, কখনও ঈদ বা কখনও জাতীয় বাজেট ঘোষণার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই অশুভ প্রবণতা লক্ষ্য করে আসছি আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে এবং আজও সেই একই ধারা অব্যাহত আছে। বরং বলা যায় যে, সেই প্রবণতা এখন বেড়ে গেছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। একটি জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেলে এ নিয়ে কথা বলতে না বলতে আরেকটি জিনিসের দাম বেড়ে যায়।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, রোজায় খেজুরের চাহিদা ৬০ হাজার টন। জানুয়ারিতে এসেছে ২২ হাজার টন। এতে প্রতি কেজিতে সর্বনিম্ন ৩০ টাকা, সর্বোচ্চ ১২২ টাকা শুল্ককর কমেছে। ব্যবসায়ীরা জানুয়ারি থেকে পুরোদমে আমদানি শুরু করেছেন। রোজা শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে আরও খেজুর আসবে। পেঁয়াজ আমদানি কম। তবে দেশে পেঁয়াজের ভরা মৌসুম চলছে। দাম অনেকটাই কমেছে। রোজার মাস হবে পেঁয়াজের ভরা মৌসুম। ফলে দাম নিয়ে উদ্বেগ কম বলে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করছেন। এর প্রভার যদি বাজারে থাকে। দেশের নানামুখী সংকটের কারণে কিছু দ্রব্যের সরবরাহ কম। তাছাড়া ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ঋণপত্র খুলতে কিছু ব্যাংকের অনীহায় রোজার বাড়তি চাহিদার কারণে কিছু দ্রব্যের দাম হয়তো অল্পকছু বাড়তে পারে। কিন্তু প্রায় সব পণ্যের অতিরিক্ত দাম বাড়ানো কোনো অবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। নিত্যপণ্য আমদানিতে যুক্ত কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাণিজ্য করার মতো অবস্থায় নেই। এতে নিত্যপণ্য সরবরাহে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল, তা কেটেছে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়া ও নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়ায়। রোজার সময় আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত আসতে পণ্যের দামের পার্থক্য অনেক বেশি বেড়ে যায়। অনেকে সুযোগ নেন। এ জন্য সরকারের নজরদারি বা তদারকি বাড়াতে হবে।
বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সংসার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যদিও সরকারের হিসাবে, গত এক বছরে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, মজুরিও বেড়েছে। টাকার অঙ্কে বেড়েছে মাথাপিছু আয়। কিন্তু সবই কাগজে-কলমের হিসাব। আর তাতে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি পাচ্ছে না; বরং সংসার চালাতে অনেককে ধারদেনা করতে হচ্ছে। ভাঙতে হচ্ছে সঞ্চয়। মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতিই খেয়ে ফেলছে মানুষের আয়। এই অবস্থায় সামনে আসছে রমজান। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মধ্যবিত্তদের অবস্থা আরো খারাপ হবে।
রমজানে সব জিনিসের চাহিদা বেড়ে যায়, এটা কিন্তু ঠিক নয়। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের চাহিদা অনেক বাড়তে দেখা যায়। সেসব পণ্যেরই দাম বৃদ্ধি পায় বেশি। এজন্য ভোক্তাদেরও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়। বাজারে পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও অনেক ভোক্তাকে দেখা যায়, রমজান শুরুর আগেই অহেতুক পণ্যসামগ্রী কিনে ঘরে এনে জমা করতে। এতে বাজারে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয় এবং এর সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী ওইসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। ভোক্তারা বুঝতে পারেন না, তাদের এমন আচরণের কারণে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং এতে সাধারণ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এজন্য আগে থেকে প্রচারণা চালাতে হবে। ব্যবসায়ী নেতারা ও মিডিয়া এ বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারে।
বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি এবং ডলার সংকটের কারণে এবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে আগের তুলনায় বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কাজেই রোজা শুরুর আগেই যাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর কৌশল বাস্তবায়ন করতে না পারে, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে এখন থেকেই। রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা থাকে, সেগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বর্তমান লাগামহীন বাজার দরে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। একটি ক্রয় করতে গেলে আরেকটি ক্রয় করতে পারছে না তারা। তাই সবকিছু বিবেচনা করে সরকারের প্রতি আমাদের আবেদন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানো এবং নজরদারির মাধ্যমে মূল্য স্থিতিশীল রাখা অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হোক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক