ফখরুল ইসলাম নোমানী
বিদায়ের পথে ইবাদতের বসন্তকাল মাহে রমজান। শেষ সময়গুলো খুবই মূল্যবান। বেশি ইবাদতে মশগুল থেকে পুরো বছরের পুঁজি সংগ্রহ রাখা মুমিনের কাজ। এখন যেসব আমল বেশি করে করা যায় তাহাজ্জুদের নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, তওবাহ-ইস্তেগফার, দোয়া-দরুদ এসব অন্যতম। এ ছাড়াও সেহরি ও ইফতারিতে আত্মীয়স্বজন, অভাবী পড়শিদেরও খেয়াল রাখা, বেজোড় রাতে শবে কদর তালাশ, এতেকাফ করা, দান সদকা ও বেশি বেশি দোয়া করা। শেষ দশকে লাইলাতুল কদর ও জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পেতে বিশেষ কিছু ইবাদত ও উপায় তুলে ধরা হলো :
১. বছরের সেরা ১০ রাতের ইবাদত : রমজানের শেষ দশকের প্রত্যেকটি কাজ বা ইবাদতকে উদারভাবে দেখবেন এবং অনেক বেশি সওয়াব দেবেন। তাই প্রত্যেকের উচিত রমজানের শেষ দশকে সময় অপচয় না করে ইবাদাত-বন্দেগিতে মনোযোগী হওয়া। অলসতা ও একঘেয়েমী রমজানের ইবাদতের প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই যারা প্রথম দুই দশক অলসতায় কাটিয়ে দিয়েছে তাদের জন্য শেষ দশকের প্রতিটি রাতের ইবাদত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. বিশেষ দোয়ার মাধ্যমে ইবাদত : শেষ দশকের প্রতিটি রাতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া ও ইসতেগফারে কাটিয়ে দেওয়া। বিশেষ করে লাইলাতুল কদরের দোয়া নামে পরিচিত দোয়াটি বেশি বেশি পড়া। যে দোয়াটি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে শিখিয়েছেন। উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন ; তুহিব্বুল আফওয়া ; ফাফু আন্নি।
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল ; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন ; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।
৩. লাইলাতুল কদর তালাশ করা : রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশ করতে থাকা। কারণ লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতের ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের সমান। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরের রাতে বিশ্বাস ও পুরস্কারের আশায় ইবাদাতরত অবস্থায় থাকবে আল্লাহ তাআলা তার অতিতের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।
৪. দোয়ার একটি সূচি তৈরি করে নেওয়া : শেষ দশকের বিজোড় রাতে আল্লাহর কাছে ন্যায়ের পথে চলা এবং অন্যায় পথ থেকে বিরত থাকতে নিজের জন্য পরিবারের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য তথা নির্যাতিত মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করতে একটি তালিকা তৈরি করা। বিশেষ করে কোরআনে বর্ণিত ক্ষমা প্রার্থনার দোয়াগুলো সেজদা ও তাশাহহুদে পড়ার চেষ্টা করা।
৫. রাতের ইবাদতের জন্য দিনে ঘুমানো : রমজানের শেষ দশ দিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটুও ঘুমাননি। তিনি সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করতেন। তাই দিনের বেলায় কিছু সময় ঘুমিয়ে নেওয়া। রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে থেকে লাইলাতুল কদর পাওয়ার চেষ্টা করা।
৬. অযথা সময় ব্যয় না করা : কোনো কারণ বা প্রয়োজণ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইলেক্ট্রনিক্স মাধ্যমসহ সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় ব্যয় না করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকলেও তা যেন হয় ইবাদতের উৎস। তাই ইবাদত বন্দেগিতেই বেশি সময় ব্যয় করা। ইবাদতে মনোযোগী হওয়া।
৭. বেশি বেশি কুরআন তেলওয়াত করা : শেষ দশকে কোরআন তেলাওয়াত ও এর মর্মার্থ অনুধাবনের চেষ্টা করা। কেননা কোরআনের অধ্যয়নেই সওয়াব ও ফজিলত বেশি। তাতে সুযোগ না থাকলে শুধু তেলাওয়াতেও রয়েছে অনেক সওয়াব ও ফজিলত। তাই বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা।
৮. ধৈর্য্যের মাধ্যমে ইবাদাত করা : বছরের ১১ মাস ২০ দিন অপেক্ষার পর আসে রমজানের শেষ দশক। এ দশকে মুমিন মুসলমান হাজার বছরের সেরা রাত ‘লাইলাতুল কদর’ তালাশে অপেক্ষমান। তাই ধৈর্যসহ এ রাতের তালাশ করা জরুরি। এ দশ দিন কোনোভাবেই অধৈর্য হওয়া যাবে না। রমজানের এই শেষ দশকের প্রতিটি রাতই নিজের জীবনের জন্য চূড়ান্ত সময় ভেবে ধৈর্য সহকারে ইবাদাত-বন্দেগিতে মনোযোগী হওয়া। এ কথা মনে করে ইবাদাত করা যে এ রমজানের শেষ দশকই হয়তো জীবনের শেষ দশক।
৯. বেশি বেশি দান-সাদকা করা : শেষ দশকের রাতে নামাজ, জিকির-আজকার, তেলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদাতের পাশাপাশি যারা ইতেকাফে বসে না, তাদের জন্য গরিব-দুঃখীর মাঝে আল্লাহর ওয়াস্তে বেশি বেশি দান-খয়রাত করা জরুরি। এতিম মিসকিনদের সাধ্যানুযায়ী সহায়তা করায় রয়েছে অনেক সওয়াব। আর তা যদি হয় লাইলাতুর কদরে তবে সে দানের হাজার মাসের সমান দানে পরিণত হবে।
১০. অন্যকে ইবাদাতে অনুপ্রাণিত করা : রমজানের শেষ দশকে ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, মা-বাব, ভাই-বোন, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের রাতে ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া। তাদের সঙ্গে ইবাদতের প্রতিযোগিতায় নামার প্রস্তুতি গ্রহণ করা। সবাইকে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি অনুপ্রাণিত করে তোলা।
১১. ইতিকাফ করা : ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা, আটকে রাখা, নিজেকে বন্দি করা, মসজিদে অবস্থান করা ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইবাদতের উদ্দেশ্যে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ রমজানের শেষ দশকের বিশেষ আমল। ভোগবাদী দুনিয়ার মিথ্যে মায়া ত্যাগ করে, পরিবার-পরিজন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বর্জন করে কেবল মনিবের সন্তুষ্টির জন্য একান্তে বসে ইবাদত বন্দেগি করা উচ্চ মানসম্পন্ন মুমিনের পরিচয়। আয়েশা (রা.) বলেন মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাঁকে ওফাত দান করেন।
১২. সাদাকাতুল ফিতর আদায় : সাদাকা অর্থ দান, জাকাত ইত্যাদি। আর ফিতর অর্থ ভঙ্গ করা, বিদীর্ণ করা, সৃষ্টি করা ইত্যাদি। উভয় শব্দের যৌথ অর্থ দানের মাধ্যমে ভঙ্গ করা। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন দান ও ঈদ উদ্যাপনের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করা হয় তাই এই দান সাদাকাতুল ফিতর এবং এই দিনকে ঈদুল ফিতর বলা হয়। ধনী স্বাধীন মুসলমান ব্যক্তির ওপর সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব। মহানবী (সা.) রমজানে অধিক পরিমানে দান করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন রমজানে রাসুল (সা.) এর দান সদকা করার ব্যাপারে উৎসাহ উদ্দীপনা অধিক বেড়ে যেত। তিনি রমজান মাসকে শারুল মুয়াসাত তথা সহানুভূতির মাস বলে ঘোষণা করেন। সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাদাকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক ও অশালীন বাক্যালাপ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং নিঃস্বদের খাদ্য দানের জন্য।
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত : পবিত্র কুরআন ও সহিহ্ হাদিস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শবেবরাত নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহদের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে-লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে তার কোনো অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং রাসূল সাঃ-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গ্রহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহানআল্লাহ বলেন আমি এ (কুরআনকে) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো কদরের রাত কী ? কদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম-কল্যাণময়। রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোই (অর্থাৎ ২০,২২,২৪,২৬ ও ২৮ রোজার দিবাগত রাত) হলো শেষ দশকের বিজোড় রাত। এ রাতের আরেকটি গুরুত্ব হলো এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। তাহলে লাইলাতুল কদরের আরেকটি অর্থ হয় ভাগ্য রজনী।
পরিশেষ : আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে মর্যাদার রাত লাইলাতুল কদর দান করুন। এ রাতের বরকত ও কল্যাণে মুমিন বান্দার বিগত জীবনের গোনাহ মাফ করে দিন। পরবর্তী পুরো বছরের কল্যাণ বরকত ও উত্তম রিজিকে পরিপূর্ণ করে দিন। লাইলাতুল কদর মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মুমিন বান্দাদের জন্য অনেক বড় একটি উপহার এই উপহার কোনো ভাবেই যাতে হাত ছাড়া না হয়ে যায় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে লাইলাতুল কদর প্রাপ্তিতে ইবাদাত-বন্দেগি করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট