এম এ হোসাইন
পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। তবে সংস্থাটির কার্যক্রম বছরের বেশিরভাগ সময় তেমন দৃশ্যমান হয় না। কিন্তু রমজানের আগে এলে হঠাৎ নড়েচড়ে বসে বিএসটিআই। এবারও সংস্থাটি শতাধিক পণ্যের মান যাচাই করতে মাঠে নেমেছে। বাজার ও কারখানা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে তারা।
তবে প্রশ্ন উঠছে, এই কার্যক্রম কতটা কার্যকর? কারণ, বিএসটিআই’র পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হতেই রমজান শুরু হয়ে যায়, আর মানহীন পণ্য বাজার থেকে সরানোর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে রমজান প্রায় শেষ হয়ে আসে। ফলে পরীক্ষার ফল প্রকাশ পেলেও এর কোন বাস্তব প্রভাব পড়ে না। ততদিনে ভোক্তারা সেই মানহীন পণ্য কিনে ফেলেন ও ভোগও করেন। ফলে এই তদারকিকে অনেকেই লোক দেখানো বলে মনে করছেন।
বিএসটিআই চট্টগ্রামের পরিচালক মো. গোলাম রব্বানী পূর্বদেশকে বলেন, খোলা বাজার থেকে পণ্যের নমুনা সংগ্রহের জন্য তিনটি গ্রæপ গঠন করা হয়েছে, যারা বাজার ও কারখানা থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে। প্রতিটি গ্রæপ কমপক্ষে ৩০টি করে নমুনা সংগ্রহ করবে। চট্টগ্রামে নিজস্ব ল্যাবে কিছু পরীক্ষা করা হবে, আবার কিছু নমুনা ঢাকায় পাঠানো হবে। পরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হবে।
বাংলাদেশে খাদ্য ও শিল্পপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের হলেও বাজার তদারকিতে সংস্থাটি বরাবরই পিছিয়ে আছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মাসে বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু বাস্তবে রমজানের আগে সাময়িক অভিযান ছাড়া তেমন কিছুই করা হয় না।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন পূর্বদেশকে বলেন, বিএসটিআই’র এই কার্যক্রম লোক দেখানো ছাড়া কিছু নয়। রমজানের ঠিক আগে পণ্যের মান পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হলেও, ফলাফল প্রকাশ হতে বিলম্ব হয়। ফলে ভোক্তারা সেই মানহীন পণ্যই কিনতে বাধ্য হন।
তিনি বলেন, মানহীন পণ্য বাজার থেকে সরাতে বিএসটিআইকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়। প্রথমে কোম্পানিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, তারপর তাদের সময় দেওয়া হয় মান উন্নয়নের জন্য। এতে করে পুরো রমজান পার হয়ে যায়, অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হন ভোক্তারাই। অন্তত দুইমাস আগে থেকে এ কার্যক্রম পরিচালনা হলে অনেকটা উপকার আসতো।
২০২৪ সালের গেøাবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স অনুযায়ী, খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে। ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যমান নিশ্চিত করতে বিএসটিআইকে শুধু রমজানকেন্দ্রিক অভিযান নয়, বরং সারাবছর নিয়মিত বাজার তদারকি করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটি চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া পূর্বদেশকে বলেন, খাদ্যপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য যেন সঠিক পরিবেশে উৎপাদন হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মানহীন খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের মধ্যে নানা রোগ ছড়াচ্ছে, যা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য আরও বিপজ্জনক।
তিনি বলেন, পণ্যের মান নির্ধারণ থেকে শুরু করে বাজারে সঠিক মানের পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিত তদারকিতে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই তদারকি হয় না। ফলে খাদ্যপণ্যের মান নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
রমজানে অধিক চাহিদাসম্পন্ন খাদ্যপণ্যের মধ্যে থাকে সেমাই, চিনি, মুড়ি, মসলা, ঘি, দুধ, ড্রিংকস, ভোজ্যতেলসহ নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য। এসব পণ্যের মান নিশ্চিত না হলে জনস্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু বাজারে এসব পণ্যের মান ঠিক আছে কিনা, তা যাচাই করতে বিএসটিআই যে উদ্যোগ নেয়, তা কার্যকর না হওয়ায় জনগণের মধ্যে উদ্বেগ থেকেই যায়। প্রতি বছর দেখা যায়, রমজানের সময় বিএসটিআই যে পণ্যগুলোর নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষায় কিছু মানহীন পণ্য ধরা পড়ে। কিন্তু সেই পণ্য বাজার থেকে তোলার দীর্ঘসুত্রিতার কারণে ততদিনে রমজান পার হয়ে যায়। ফলে কার্যত কোন সুফল পায় না সাধারণ মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যপণ্যের গুণগত মান রক্ষা করতে হলে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। লোক দেখানো তদারকি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিএসটিআইকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে, যাতে রমজানের সময় মানুষ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে পারে। নয়তো রমজান এলে শুধু ‘নড়েচড়ে বসা’ দিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব নয়। বিএসটিআই যদি নিয়মিত বাজার তদারকি করত, তাহলে রমজানে এসে এত তড়িঘড়ি করে নমুনা সংগ্রহের প্রয়োজন হতো না। সারাবছর বাজার মনিটরিং জোরদার করা হলে মানহীন পণ্য বাজারে টিকতে পারত না এবং জনগণ নিশ্চিতভাবে নিরাপদ খাদ্য পেত।