’২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে। এতে রপ্তানি খাত বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ার আশঙ্কার করছেন পোশাক শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের আর্থিক প্রবাহেও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) কর্তৃক আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্যে এটিই অনুমান করা যায়। সংবাদ সন্মেলনে বলা হয়, গত এক বছরে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে ২৫৮টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প খাতে এক ভয়াবহ সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে, রপ্তানি অর্ডার কমেছে, ব্যাংক ঋণ পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়েছে, আর কর্মসংস্থানে নেমেছে বড় ধাক্কা। সংগঠনের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, “দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অস্থিরতা এবং কাঁচামালের দামবৃদ্ধির কারণে অনেক উদ্যোক্তা উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। ফলে তারা একে একে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।” উক্ত সম্মেলনে আরো জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের শেষ দুই মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৫-৬ শতাংশ কমে গেছে। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ জুড়ে রাখে, ফলে এই পতন অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। শুধু তাই নয়, বিজিবিএর তথ্য অনুযায়ী, ২৫৮টি কারখানা বন্ধ মানে কমপক্ষে দেড় লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হারানো। অর্থাৎ একটি কারখানা বন্ধ হওয়া মানে কেবল উৎপাদন বন্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িত অসংখ্য শ্রমিকের জীবিকা, ডজনখানেক বায়িং হাউস, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আস্থা ও দেশের শিল্প খাতের ভাবমূর্তি। শুধু শ্রমিক নয়, এর সঙ্গে যুক্ত পরিবহন খাত, প্যাকেজিং, বীমা, ব্যাংক, রপ্তানি-লজিস্টিকসসহ আরও বহু উপখাত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখন প্রতিটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার পেছনে গল্প আছে— কেউ টিকতে পারেননি গ্যাসচাপের ওঠানামায়, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এলসি (Letter of Credit) জটিলতায়, আবার কেউ বিদেশি ক্রেতাদের ‘পেমেন্ট ডিলে’ ভুগেছেন। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ব্যাংক ঋণ, কাঁচা মালের সংকটের কারণে পোশাক শিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে যুক্ত হয়েছে একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্যারিফ বাড়ানোর উদ্যোগ। এ যেন মড়ার উপর খাড়ার গা। বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে চলছে চরম অসন্তোষ। বন্দর ব্যবহারকারী সকল ব্যবসায়ী ও সংগঠনসমূহসহ পণ্য পরিবহন ট্রাক, লরি, ও কাভার্ডভ্যানের মালিক-শ্রমিক, সিএনএফ এজন্ট সমূহের বিভিন্ন সংগঠন বন্দরে কর্ম বিরতিসহ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চালিয়ে আসছে প্রায় দশদিনব্যাপী। কিন্তু তা নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিজিবিএর পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত একাধিক সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে যেমন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিজিএটিএমইএ ও বিজিবিএ। এসব সংগঠনসমূহকে এক ছাতার নিচে এনে কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে পোশাক শিল্পের ধংসের ষড়যন্ত্র রুখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন প্রয়োজন সরকার, উদ্যোক্তা ও ক্রেতা এই তিন পক্ষের যৌথ উদ্যোগ, যাতে এই শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিআমরা আশা করি, সরকার দেশের অন্যতম প্রধান এ রপ্তানি খাতকে সুরক্ষায় দ্রæত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিবে।
পাশাপাশি, সংকট মোকাবিলায় বিজিবিএ যে সাতটি সুপারিশ দিয়েছে, তা যথাযথ পর্যালোচনা করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিবে। পোশাক শিল্প মালিকরা মনে করেন, তাদের ৭দফা প্রস্তাবনা আমলে নেয়া হলে, খাতটি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। দাবিগুলোর অন্যতম হল, ১. কারখানা নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স কঠোরভাবে নিশ্চিত করা। ২. রপ্তানির সময়সীমা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা দেওয়া। ৩. এলসি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নে ব্যাংক ও কারখানাকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ৪. শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও ম্যান-মেড ফাইবার ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া। ৫. নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৬. অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়াতে আন্তর্জাতিক মেলা আয়োজন। ৭. এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা, যাতে রপ্তানি প্রণোদনা হারিয়ে না যায়।











