রথযাত্রা-তত্ত্ব

2

স্বপ্না চক্রবর্ত্তী

সনাতন ধর্ম পৃথিবীর প্রাচীন ধর্ম। সনাতনধর্মীদের রয়েছে বারো মাসে তেরো পূজা-পার্বন। বিভিন্ন উৎসব-মহোৎসবে আলোকোজ্জ্বল এ ধর্ম। রথযাত্রা তন্মধ্যে অন্যতম। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব উদযাপিত হয়। আবার এক সপ্তাহ পরে ফিরতি রথযাত্রার মধ্যদিয়ে এ উৎসবের ঘটে পরিসমাপ্তি। ‘জগৎ’ শব্দের অর্থ বিশ্ব এবং ‘নাথ’ মানে ঈশ্বর। যিনি জগতের ঈশ্বর, তিনি-ই ‘জগন্নাথ’। যেই গৌর, সেই কৃষ্ণ, সেই জগন্নাথ। শ্রীজগন্নাথ তাঁর ভ্রাতা বলরাম এবং ভগ্নি সুভদ্রা মহারাণীকে নিয়ে রথে উপবিষ্ট হন এবং ভক্তগণ স্তুতি-কীর্তন করতে করতে শোভাযাত্রা সহকারে রথ টেনে বৃন্দাবনের দিকে যে যাত্রা করেন তাকে বলা হয় রথযাত্রা। রথযাত্রা ভগবানের (জগন্নাথ) মাধূর্যময় লীলা। কারণ এতে সরাসরি শ্রীকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসা যায়। জগন্নাথ এতোই কৃপাময় যে যারা মন্দিরে এসে ভগবানকে দর্শন করে না তাদের পর্যন্ত কৃপা করার জন্য তিনি ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে ভ্রাতা বলরাম ও সুভদ্রা দেবীসহ রথে পরিভ্রমণ করেন।
শাস্ত্রে বলা আছে- ‘রথে বামনং দৃষ্ট্বা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।’ অর্থাৎ রথোপরি জগন্নাথ দেবকে দর্শন করলে দর্শনকারীর মুক্তি লাভ হয়। এ উৎসবে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য হলো আত্মোপলব্দির পথে এগিয়ে যাওয়া। রথযাত্রার একটা প্রাকৃতিক রূপরেখা রয়েছে। জ্যোতির্বিদ্যায় দেখা যায়, মহাকাশে বিষুবরেখা থেকে সূর্য একবার উত্তরে এবং একবার দক্ষিণে বার্ষিক পরিক্রমা করে। মূলত সূর্যের বিষুব রেখার উত্তর ও দক্ষিণের পরিভ্রমণের সঙ্গে রথযাত্রা এবং ফিরতি রথযাত্রার মিল রয়েছে। ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের পুরীর রথযাত্রা মূলকেন্দ্র। সমুদ্রতীরের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশবেষ্টিত পুরীর জগন্নাথ মন্দির। এ মন্দির প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে থেকেই ধর্মীয় উৎসব হিসেবে রথযাত্রা উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে।
রথোপরে একপাশে প্রভু জগন্নাথ, মাঝখানে সুভদ্রা এবং বাঁয়ে বলভদ্র (বলরাম) রথে আসীন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম সম্পর্কে ভাই-বোন। এই রথের আধ্যাত্মিক বিষয়টি হচ্ছে- রথ আমাদের শরীর বা দেহযন্ত্র। রথ এই দেহের প্রতীক। আত্মা হলো রথী বা রথের মধ্যে অবস্থানকারী। বুদ্ধি হলো সারথি বা চালক। মন হচ্ছে লাগাম। মানবদেহের ইন্দ্রিয়গুলো হচ্ছে ঘোড়া। ঘোড়া যেমন গাড়ি বা রথ। তেমনি আমাদের দেহকেও টেনে নিয়ে যায় ইন্দ্রিয়শক্তি। ইন্দ্রিয় শক্তি যদি সংযত হয়, সুনিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে মানব তার কল্যাণের পথের সন্ধান পাবে। আর এ ইন্দ্রিয় শক্তি যদি সংযত না হয় তবে এই রথ কোথায় টেনে নিয়ে যাবে তা বলা দুষ্কর। আমাদের সনাতন ধর্মে রথ উৎসবের রসধারা প্রবাহিত হয় আপন গতিতে। কেননা রথে আসীন শ্রীজগন্নাথদেবের এ বিগ্রহ জীবন্ত। ভক্তপ্রাণ নরনারী প্রার্থনা জানাতে সমবেত হয় এই উৎসবে। অসংখ্য নরনারী প্রার্থনা জানাতে সমবেত হয় এই উৎসবে। অসংখ্য নরনারীর মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হয় এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় বলেছিলেন- ‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম, ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।’ আমরাও সশ্রদ্ধ চিত্তে প্রণাম জানাই, রথযাত্রা আমাদের পূর্ণযাত্রা হোক।
লেখক : সমাজসেবী ও প্রাবন্ধিক