শেখ বিবি কাউছার
পৃথিবীর যেদিকেই তাকাই মহান রাব্বুল আলামীনের কুদরতের যেন শেষ নেই। আমরা হয়তো অনেক সময় মা-বাবা, কিংবা বন্ধুদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাই। আবার অনেক সময় প্রতিষ্ঠান থেকেও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়। যেটাকে আমরা বলি শিক্ষা সফর। এটি ভ্রমণ থেকে জ্ঞান অর্জনকে বুঝায়। আমাদের একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন জ্ঞান শুধুমাত্র বই থেকে অর্জন করা যায় না, জ্ঞান অর্জন করতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে হবে। ঠিক তখনই অনুধাবন করতে পারব আল্লাহর সৃষ্টি কতই না সুন্দর। একজন ফরাসি ঔপন্যাসিক নাম গুস্তাভ ফ্লুবেয়ার। তিনি ভ্রমণ নিয়ে চমৎকার একটি কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন, “ ভ্রমণ মানুষকে বিনয়ী করে তোলে এবং জানতে পারে দুনিয়ার তুলনায় সে কত ক্ষুদ্র। ” আসলেই তো আমরা যখন প্রকৃতির মাঝে দাঁড়ায়, প্রকৃতির তুলনায় আমরা কতই না ক্ষুদ্র! কিন্তু সেটা কি আমরা অনুভব করি! ভ্রমণের কথা আসলেই একজন বিখ্যাত পরিব্রাজকের কথা না বলেই নয়! পরিব্রাজক বলাতে নিশ্চয়ই আপনাদের মাথায় একটি নাম বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে? তাই না! হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা। যিনি ইবনে বতুতা নামেই সমধিক পরিচিত। আপনারা জেনে অবাক হবে যে, এই বিখ্যাত পরিব্রাজক বাংলাদেশেও এসেছিলেন। সেই কথা না’’হয় পরে বলি। চলুন আগে তাঁর সম্পর্কে জেনে আসি।
আজ থেকে প্রায় ৬৮০ বছর পূর্বে মাত্র ২১বছর বয়সে তিনি একাই মরক্কোর তানজাহ শহর ত্যাগ করেন হজ্ব করার উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ ২৯ বছর তিনি ঘুরে বেড়িছেন বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ। কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করছি জানার সুবিধার্থে। উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকা, মিশর, সিরিয়া, পারস্য (বর্তমান ইরান), আরব উপসাগর, আনাতোলিয়া, মধ্য ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, সুমাত্রা,চীন, স্পেনসহ বাংলা। তখনকার সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত আধুনিক ছিল না। সুদীর্ঘ এই সময়ে ঘোড়া, ঘোড়ার গাড়ি, উট, নৌকা এবং পায়ে হেঁটে বর্তমান সময়ে প্রায় ৪৪ টি দেশ ঘুরে পাড়ি দিয়েছিলেন ৭৫, ০০০ মাইল। তাঁর সাথে বহু বিভিন্ন দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, সুফিসাধকসহ অনেকের সাথে দেখা হয়। তিনি এসব আবার লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থ ‘ রিহলা বা সফরনামা’য়।
এত কথা বলার পেছনে কারণ হলো এই বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক আমাদের বাংলায় এসেছিলেন তাও আবার আমাদের চট্টগ্রাম দিয়ে। এটি আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগের কথা। তখন ছিল ১৩৪৫/ ১৩৪৬ খ্রি.। বাংলার সুলতান ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ। এখন নিশ্চয়ই আপনারা ভাবছেন বহু দেশ ঘুরে তিনি কেন এসেছিলেন আমাদের এই বাংলায়? তাহলে শোনেন, তিনি সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সাথে দেখা করতে সুদূর মরক্কো থেকে এখানে আসেন নি। তিনি এসেছিলেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক মহান অলির সাথে দেখা করতে, বাংলার বিখ্যাত দরবেশের সান্নিধ্য লাভ করতে। তিনি হলেন হজরত শাহজালাল ( র.)। পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যদি বাংলায় আসেন হযরত শাহ জালাল (র.)’র সাথে দেখা করতে তাহলে একবার ভাবুন তো হযরত শাহ জালাল ( র.) কতই না বড় মাপের দরবেশ ছিলেন! তিনি শুধুমাত্র আজকের জন্য বিখ্যাত তা কিন্তু নয় তিনি আজ থেকে প্রায় সাত’শ বছর আগেও বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁকে কতটুকু জানি?
গৌড় গোবিন্দের সাথে যুদ্ধ, জালালি কবুতরের গল্প কিংবা জায়নামাজে চড়ে নদী পার এখানেই শেষ নয় হযরত শাহ জালাল ( র.)’র মহত্ত¡।
তিনি সেই সুদূর ইয়েমেন থেকে সিলেটে এসেছিলেন ইসলামের সুমহান বাণী নিয়ে। কিন্তু সিলেট কেন? নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটা মনে মনে উঁকি দিচ্ছে! আসলে কি জানেন! প্রতিটি শহর গড়ে ওঠার পেছনে কোনো না কোনো অলি বা সুফিসাধকদের অবদান থাকে। সেটি আমরা স্বীকার করি আর নাই করি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় মূলত দরগাহ বা সুফিসাধকদের মাজারকে কেন্দ্র করে জনপদ, স্থান, জেলা, বিভাগ ইত্যাদি বিস্তৃত হয়েছে।
একবার ভাবুন তো! আরবের মরুপ্রান্তর হয়ে বহু সুফিসাধক, পীর আউলিয়া ইসলামের আধ্যাত্মিক বাণী নিয়ে এই বাংলায় আসেন। উনারা ভোগ বিলাসে জীবন কাটানোর জন্য আসেন নি। আসেন নি রাজা, বাদশাহ, সম্রাটদের সাথে দেখা করতে, এই বাংলায় শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে কিংবা বিধর্মীদের হত্যা করার জন্য নয়। এখানে আসার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল তা হলো মানুষের মন জয় করা, তবে জোর করে নয়, কথা ও কর্ম দিয়ে। তাও আবার ইসলামের আধ্যাত্মিক বাণী দিয়ে।
ফিরে আসি সিলেট বিভাগের কথায়। সিলেটকে আবাদ করেছেন যিনি তিনি হলেন হযরত শাহজালাল ( র.)। তাঁর পূর্ণ নাম শায়খুল মাশায়েখ মখদুম শায়েখ জালাল উদ্দীন আল মুজররাদ ইবনে মুহম্মদ। যিনি হযরত শাহজালাল নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন।
ধারণা করা হয়, ৭০৩ হিজরি মোতাবেক ১৩০৩ খ্রি. ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে সিলেট অঞ্চলে এসেছেন। মৌলভি মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন হায়দার ‘সোহেলী এমন’ নামে ( ১৮৬০ সালে ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত) হযরত শাহ জালাল( র.) জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন।
সোহেলী এমন-গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায় যে, ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে) হযরত শাহ জালাল (র.) জন্মগ্রহণ করেছেন। উনার জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরব হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়ামেন দেশের কুনিয়া নামক শহরে। হযরত শাহ জালাল (র.) যখন তিন মাসের শিশুবালক, তখনই উনার মাতার ইন্তেকাল করেন। তিনি শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবিরও ছিলেন একজন দরবেশ। তিনি আরবী ভাষায় কোরআন-হাদিস শিক্ষা দেয়া সহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে আহমদ কবীর হয়রত শাহ জালাল (র.)) কে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হুজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সাথে হযরত শাহ জালাল (র.)) কেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।
রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন নামে একজন আমেরিকান ইতিহাসবিদ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, হযরত শাহ জালাল ( র.) এঁর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ইবনে বতুতার মাধ্যমে। ১৩৪৫ সালে ইবনে বতুতা সিলেটের কাছে এক পাহাড়ি গুহায় হযরত শাহ জালালের( র.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মরক্কোর এই পরিব্রাজক শাহ জালাল (র.) কে বয়স্ক দরবেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
লেখার শুরুতে বলেছিলেন তিনি এত দেশ ঘুরে কেন হিন্দুস্তান হয়ে এই বাংলায় অর্থাৎ সিলেটে আসেন? এটি নিয়ে একটি কাহিনী আছে। চলুন তবে জেনে আসি।
হযরত শাহ জালাল (র.) ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। সেই দেশের এক রাজার পুত্র ছিলেন শেখ আলি। রাজার মৃত্যুর পর পুত্র শেখ আলি হলেন রাজ্যের রাজা। কিন্তু তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে সফরসঙ্গী হবেন হযরত শাহ জালাল ( র.)’র সাথে। শাহ জালাল ( র.) তাঁকে অনেক বোঝাতে চাইলেন যে তুমি তোমার জায়গায় বসে রাজ্যে সত্য ও ন্যায়ের আলো জ্বালিয়ে দাও এবং গরিবের প্রতি একজন নিষ্ঠাবান রাজার যে দায়িত্ব, তা পালন করো, কারণ এতেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। শেখ আলি তাঁর সব উপদেশ নীরবে শুনলেন ঠিক কিন্তু পরমুহূর্তে করজোড়ে পুনরায় তাঁর সঙ্গী হওয়ার জন্যে মিনতি প্রকাশ করলেন। অবশেষে তিনি আর না করতে পারলেন না। হযরত শাহ জালালের ( র.) পীর আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি যে মাটি তাঁকে দিয়েছিলেন, সেই মাটি শেখ আলির হাতে দিয়ে বললেন, “ আমরা যখন যেখানে গিয়ে পৌঁছাব, সেখানকার মাটির সঙ্গে এই মাটির রূপ-রস-গন্ধ তোমাকে মিলিয়ে দেখতে হবে, এটাই হলো তোমার কাজ। শেখ আলিকে জিহব্বা দিয়ে চুষে মাটি নিরীক্ষণ করতে হতো, সে কারণে আজও তাঁকে চাষনি পীর নামে অভিহিত করা হয়। একেই বলে গুরুর প্রতি ভক্তি, প্রেম। যিনি কিনা রাজত্বের এত লোভনীয় আকর্ষণ ত্যাগ করে শাহ জালালের প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে যার কারণে অনিচ্ছা সত্তে¡ও শাহ জালাল ( র.) তাঁকে তাঁর ভক্ত ও সফরসঙ্গী না করে পারলেন না। যে সময়টাতে তিনি দিল্লি পৌঁছান,তখন ছিল সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির রাজত্বকাল, আর দিল্লির আধ্যাত্মিক মসনদে আসীন ছিলেন চিশতিয়া তরিকার প্রবাদপুরুষ হযরত খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া। সেই সময়ও ধর্মীয় আলেম
স¤প্রদায় খাজা নিজামউদ্দিনের কানে শাহ জালালের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তোলেন। কিন্তু তিনি শাহ জালাল ( র.) কে আধ্যাত্মিক জগতের মহাপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ফার্সিতে একটা কথা আছে, ‘ ওয়ালি রা ওয়ালি শানাসাদ ’, অর্থাৎ একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিই আরেকজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিকে চিনতে পারেন৷ কিংবদন্তি আছে, খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া( র.) তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ ও আতিথেয়তা প্রদান করেন এবং সেখান থেকে বাংলায় আসার সময় তিনি তাঁকে প্রীতি নিদর্শনস্বরূপ এক জোড়া কবুতর দেন। আজো তাঁর দরগাহতে যে কবুতরগুলো দেখতে পায় সেগুলো খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া ( র.) দেয়া কবুতর। যা জালালি কবুতর নামে পরিচিত।
সেই যে চাষনী পীরের কথা বলেছিলাম, তিনি সিলেটে এসেই মাটি নিরীক্ষণ কাজে লেগে গেলেন। এভাবে দীর্ঘ দিন ঘুরাঘুরির পর সিলেট শহরের একপাশে আম্বরখানার কাছেই এক টিলা খুঁজে পেলেন, যে টিলার মাটির সাথে আরবের শাহ জালালের গুরুর দেয়া মাটির পুরোপুরি মিল পাওয়া যায়। রং-গন্ধ-স্বাদ হুবহু মিল। মাটিটি নিয়ে উচ্ছ¡সিত মনে দৌড় দিলেন শাহ জালাল (র.) কাছে। এরপর শাহ জালাল (র.) আরবের মাটি ও সিলেটের সেই মাটি পাশাপাশি রেখে হাসিমাখা মুখে ভক্তদের বললেন, আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছেন। অবশেষে ৩৬০ জন অনুসারী নিয়ে দীর্ঘ এক সফরের সমাপ্তি ঘটে এই বাংলায়। এ বছর হযরত শাহ জালাল (র.) ৭০৬তম পবিত্র ওরশ শরীফ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে । আল্লাহ এই মহান অলি উছিলায় আমাদের কবুল করুন আমিন।
লেখক : প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম