যে ঘুমায় তার ভাগ্যও ঘুমায়

1

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

দুনিয়াতে সবাই বড় হতে চায় কিন্তু বড় সবাই হতে পারে না। বড় হতে প্রয়োজন প্রচন্ড ইচ্ছা ও সাধনা। সাধনার জন্য প্রয়োজন সঠিক মন। সাধক মন ছিলেন বলেই সাধারণ একজন অন্ধ মানুষ মহাকবি মিল্টন হয়ে উঠেন। সাধক মন নিয়ে বধির বিটোফেন হয়ে যান খ্যাতিমান সঙ্গীত রচয়িতা। সাধনার ফলে কাঠুরিয়ার সন্তান, মুদির দোকানদার আব্রাহাম লিঙ্কন আমেরিকার সেরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দারিদ্রতার কারণে যে ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণীতে শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটান, কঠোর সাধনায় সে ছেলেটি হয়ে উঠেন জগৎ বিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’ বিজয় করেন নোবেল পুরস্কার। তাদের সবার সাফল্যের পিছনে ছিল নিবিড় সাধনা।
বৈজ্ঞানিক টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৯ সালে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার কার দুনিয়া ব্যাপী আলো ছড়িয়ে দেন। বিদ্যুতের আলো জ্বালাতে তিনি ৯ হাজার ৯শত ৯৯ বার ব্যর্থ হন। দশ হাজার বারে তিনি সফল হন। তাঁর আবিষ্কারের ফলে পৃথিবী আলোকিত। তিনি দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে ছিলেন, ‘প্রতিভা এক ভাগ আর ৯৯ ভাগ পরিশ্রম আর সাধনা।
যে কাজে যে ব্যক্তি আনন্দ পায়, সে কাজে সে মানুষ উন্নতি সহজেই করতে পারে। আলভা এডিসনের নিকট কঠোর পরিশ্রম ও সাধন কষ্টের ছিল না, আনন্দের ছিল বলে ষোল হতে আঠারো ঘণ্টা কাজ করার পরও তিনি বললেন, ‘আমি সারাজীবনে একদিনও কাজ করিনি’। গবেষণা ও সাধনা তার নিকট ছিল আনন্দের বিষয়, তাই তাঁর কোন কষ্ট হয়নি। জর্জ বার্ণর্ড শ’ বলতেন, ‘আমার বাবার নিকট মদ ছিল নেশা, তদ্রæপ কাজ আমার নেশা। এটি আমার স্নায়ু রোগ।
মানুষ সাধনার কারণে সাধারণ মানুষ অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন। এ ধরনের প্রমান আমাদের নিকট শত শত রয়েছে। দুনিয়ার অর্ধেক মুসলমান ইমাম আজম আবু হানিফা (র.)’র মাজহাবের অনুসারী। ইমামের দাদা ছিলেন একজন ইরানী কৃতদাস। তাঁর পিতা ছোট ব্যবসায়ী হতে বড় সাওদাগরের পরিণত হন। পিতার ব্যবসার পাশাপাশি সাধনায় আইন শাস্ত্রের এত বড় বিদগ্ধ পন্ডিত হয়ে উঠবেন তা কেউ চিন্তাই করেনি। তিনি জগৎ বিখ্যাত চল্লিশ জন আইন শাস্ত্রের পন্ডিত নিয়ে গড়ে তুলেন একটি শক্তিশালী পর্ষদ। তাদের ত্রিশ বছরের গবেষণার ফলে প্রণয়ন করেন মুসলিম মহাআইনকোষ। মুসলিম সেরা আইনজ্ঞ হিসেবে বাদশাহ মনসুর ঈমামকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণের আহবান জানান। এই জালেম বাদশাহ’র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত করায় বাদশাহ তাঁকে কারাগারে বন্দী করে বহু অত্যাচার অবিচারের পর বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করেন। মহা মনীষীদের হত্যা করা যায় কিন্তু ইতিহাস ও মানুষের মন হতে মুছা যায় না। ঈমামকে শহীদ করার পর দশ দিন ব্যাপী তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ জানাজার নামাজে অংশ গ্রহণ করে।
নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বিখ্যাত কথা, ‘মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না।’ ক্ষমতা থাকলে মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করা সম্ভব, কিন্তু মানুষের শক্তি ও আদর্শকে পরাজিত করা অসম্ভব।
বিচারের নামে অবিচার করে সক্রেটিসকে যখন হেমলক বিষ পান করে হত্যার নির্দেশ দিল, তখন এক শিষ্য সক্রেটিসকে বললেন, গুরু আপনি ক্ষমা চান, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আপনাকে বেঁচে থাকা প্রয়োজন। সক্রেটিস বললেন, আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই মরে যাচ্ছি। জ্ঞানী সক্রেটিস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট জ্ঞান বিতরণ করতে চাইলেন না, তিনি জীবনের বিনিময়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়ে গেলেন, অন্যায়ের নিকট মাথানত না করে মৃত্যুকে গ্রহণ করাই শ্রেষ্ঠ।
দার্শনিক সক্রেটিসের সেরা কথা, ‘Know thyself ’ নিজকে জানো। নিজকে জানলে আপরকে জানাতে পারে। নিজকে জাগাতে পারলে অপরকে জাগাতে পারে। নিজের আলো বিকাশ ঘটাতে পারলে অপরকে আলোকিত করতে পারে। নিজকে জানা মানে নিজের শক্তিকে জানা। মানুষ নিজের শক্তি জানলে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়। দুনিয়াতে একটা মানুষকে বিশ্বাস করা যায় সে হলো ‘আমি’। যারা দুনিয়াতে নিজকে বিশ্বাস করেছেন, তারা অবিশ্বাস্য অনেক কাজ করেছেন।
একজন মানুষের নিজেই নিজের প্রধান শিক্ষক। ইতিহাসে শত শত মানুষের সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় যারা কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই খ্যাতি অর্জন করেছেন। বহু কিছু আবিষ্কার করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছেন, শিক্ষা এক বছরে যা শিখায় অভিজ্ঞতা দশ দিনে তার চেয়ে অধিক শিখাতে পারে। আত্মশিক্ষা আত্মদর্শন এক বিশাল শিক্ষার জগৎ। সব শিক্ষা তার অধীন। আত্মশিক্ষার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মেলবন্ধন কল্যাণকর। বিজ্ঞানীদের সাধনা, গবেষকদের গবেষণা, নবী পাক (দঃ)’র হেরাগুহার ধ্যান, মুসা (আ.) তুর পাহাড়ের জ্ঞান প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়।
আমার শত্রু আমি। আমরা যাকে শত্রু মনে করি সে আমাদের মূল শত্রু নয়। আমি আমাকে ধ্বংস না করলে কেউ আমাকে ধ্বংস করতে পারবে না। আমাদের মেধা কম দিয়ে মহান আল্লাহ পাক দুনিয়াতে পাঠাননি। আমরা আমাদের মেধাকে কাজে লাগাইনি, তারচেয়ে বড় আপরাধ আর কিছু নেই। জীবনে সবার সুযোগ আসে, কেউ কাজে লাগায় আর কেউ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে না লাগানোর ব্যর্থতার খেসারত সারাজীবন দিতে হয়। একদিন হতাশাগ্রস্ত হয়ে ভাবতে হবে, আমার মা-বাবা শিক্ষকের কথা গুরুত্ব দিইনি, আমার পরিবার অর্থ ব্যয় করেছেন, মা-বাবা শিক্ষক কষ্ট করেছেন, তখন সে কষ্টের অর্থ বুঝিনি। এখন যখন বুঝি তখন আমার সবই শেষ। সেই সময় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। যারা যারা আমার বিপরীত করেছে তারা আজ কোথায়, আর আমি আজ কোথায় তা ভাবলে কষ্টের সীমা থাকবে না। অনেক মনি মুক্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, বাগানে অনেক ফুল ফুটেছিল, আমি অনাদরে অবহেলায় আহরণ করিনি। যারা তা সংগ্রহ করে মালা গেঁথে জীবনকে রাঙিয়েছে। তাদের ধরে কাছে যাওয়া আজ অসম্ভব। বড় হতে হলে বড় হওয়ার স্বপ্ন থাকতে হয়। শুধু স্বপ্ন থাকলে হয় না, স্বপ্নকে ভালোবাসতে হয়। সবাই স্বপ্ন দেখে কিন্তু সফল হয় না। ঘুমিয়ে দেখা স্বপ্ন মুক্তি আনে না। যে ঘুমায় তার ভাগ্যও ঘুমায়, স্বপ্ন দেখা ভালো কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে বাস করা ভালো না।
আমরা পাঠ্যপুস্তকে অনেক কিছু পড়ি কিন্তু তার অর্র্থ আত্মস্থ করতে পারি না। কি পড়ছি তা চিন্তা ও ধারণ করতে পারি না। এ ধরনের শিক্ষার কোন উদ্দেশ্য নেই। কবি কাজী নজরুল ইসলামের যে কবিতাটি আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েছি, সে কবিতার প্রকৃত অর্থ বুঝতে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে যেতে হয়েছে। কবি বলেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে ? / তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। শিশু না জাগলেও সকাল হয়, এখানে শিশুর শক্তির জাগরণের কথা বলা হয়েছে। সন্তানের জাগরণে তার মুক্তি। সূয্যের আলোয় নয়, মনের আলোর বিকাশের কথা বলা হয়েছে। অন্ধকার দুঃখের প্রতীক। জীবনের অন্ধকার তাড়িয়ে আলোর পাল আসতে হয়। অঙ্গকার তাড়ালে দুঃখের পর সুখ আসবে। আল্লামা ইকবাল বলেছেন, রাত যত গভীর গহিন হোক, প্রভাতের সূর্য্য অনিবার্য। মানুষের শক্তির বিকাশ ঘটাতে দুঃখের পর সুখ আসবেই। কবি শেলী বলেছেন, ‘শীত যখন এসেছে, বসন্ত, কী আর দূরে থাকতে পারে ? কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বসন্ত’ নাট্যগ্রন্থটি কবি নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করে দিলেন। কবির নিকট জানতে চাইলেন, কেন নজরুলকে নাট্যগ্রন্থ উৎসর্গ করলেন ? কবি জানালেন, নজরুল জাতির জীবনে বসন্ত এনেছেন, তাই তাঁকে ‘বসন্ত’ নাট্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করলাম। কবি নজরুল নিজের জীবনে বসন্ত আনতে পেরেছিলেন বলেই জাতির জীবনে বসন্ত আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানব মনের ঘুমন্ত শিশুটিকে জাগিয়ে তুলতে পারলে একটা জাতির জাগরণ ঘটানো যায়। সব শক্তিই আপনার মাধ্য আছে, কিন্তু সে শক্তির উপর বিশ্বাস আছে কিনা সেটা বড় বিষয়। আপনি ভাবছেন, ব্যর্থ হবেন ? না কখনো আপনি ব্যর্থ হবে না, যদি আপনি বিশ্বাসী হন। এটি আমার কথা নয়, এটি আপনাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর কথা। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘ক্বাদ আফলাহাল মোমলুন’ বিশ্বাসীরা সফল হন। (কোরআনঃ ২৩:১)

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক