কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন এবং পরিবর্তিত পরিবেশ একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের বার্তা দিয়েছে। সাধারন ছাত্র-জনতা নিজেদের অধিকার আদায়ে রাজপথে থেকে সফল হয়েছে এবং দেশ পুনর্গঠন করার শপথ নিয়েছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে মানুষ আজ হোক কাল হোক তাদের অধিকার আদায় করেই ছেড়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার সুফল পায়নি মানুষ। যে কারণে সময়ে সময়ে জেগে উঠে ছাত্রজনতা। রক্ত দিয়েই আদায় করতে হয়েছে অধিকার। মুখ বুঝে সব অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য কিছুসময়ের জন্য সহ্য করলেও এদেশের ছাত্র সমাজ কিংবা সাধারন জনগণ ঠিকই জ্বলে উঠে যার সর্বশেষ উদাহরণ ২০২৪ এর এই ছাত্র-গণ আন্দোলন। এই আন্দোলনে নারী, শিশুসহ বহু মানুষের প্রাণ ঝরেছে।জাতিসংঘ বলছে, এই ছাত্র আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রেকর্ড ৬৫০ জন মানুষ।
আমি মনে করি, অনেক হয়েছে। মানুষ অতীতের তিক্ত আর বিষাক্ত পরিবেশে ফিরতে চায়না। আগামিতে একটি সুন্দর ও উন্নত এবং নির্ভয়ে অধিকার চর্চার বাংলাদেশ গঠনই এখন মূল লক্ষ্য। এদেশের বিগত দিনের রাজনৈতিক সংষ্কৃতি মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। হিংসার বীজ ঢুকিয়েছে। পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের বদলে নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতা তৈরি করেছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশ এর যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তা বেশিরভাগ সময়েই অনুপস্থিত ছিল। এসব থেকে দেশকে বের করতে, সব ধরণের বৈষম্যের অবসান ঘটাতেই ছাত্রদের এই শ্রম, ত্যাগতিতিক্ষা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে সব মানুষ রাজনীতি, ধর্ম, বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মৌলিক মানবাধিকার চর্চা করতে পারবে। স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার পাবে। ন্যায়বিচার পাবে। রাজনৈতিক বা অন্য কারো স্বার্থে ব্যবহৃত হবেনা দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি ও সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অধিকার আদায়ে আর ঝরবেনা কোন প্রাণ, দিতে হবেনা রক্ত।
দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে। মানুষ যেখানে ভোট প্রদানের কথা ভুলতেই বসেছিল সেটিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। শুধু তাই নয়, জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচনও নিরপেক্ষ করতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামাতে হবে। জালভোট প্রদান ও ভোটকেন্দ্র দখলের মতো ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি রোধে আইন প্রণয়ন ও তার শতভাগ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কোন বিকল্প নেই।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ ও মানবিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। কোন অবস্থাতেই যেন অসৎ কিংবা দলবাজ কর্মকর্তা নিয়োগ না পান তার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক সরকারের আমলেও যেন এই ব্যবস্থা অক্ষুন্ন থাকে সেজন্য সংবিধানে ধারা যুক্ত করতে হবে।
দুর্নীতি রোধে কার্যকর স্পেশাল ইউনিট তৈরি করে তাতে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে এর মাধ্যমে সব সেক্টরে সময়ে সময়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সব স্তরে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখতে তাদের মনে নৈতিক ও ধর্মীয় অনূভূতি সৃষ্টির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত এনে দেশের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতকে পরিপূর্ণ স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমের ব্যাপারে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের আপত্তি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ও যুক্তিযুক্ত সংষ্কার করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে নৈতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু সংযোজন করতে হবে। সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতনস্কেল প্রণয়ন করতে হবে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ধরনের সিন্ডিকেট এবং চাঁদাবাজি বন্ধে বিশেষ আ্যকশান কমিটি গঠনপূর্বক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের আয় বৃদ্ধির জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সহজ শর্তে প্রয়োজনীয় ঋণ প্রদান করতে হবে। সব ধরণের নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে এবং ঘুষ ও দুর্নীতি রূখতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে ব্যাপক সংষ্কার আনতে হবে। দলের নেতা নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও কর্মীদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো ও অপরাপর রাজনৈতিক দলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ধারা সংযুক্ত ও তা মেনে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ছাত্র সংগঠনগুলোকে নিজেদের কর্মীদের চরিত্রবান ও জ্ঞানমূলক সমাজ গঠনের ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। দেশের প্রতি নিখাদ প্রেম জাগ্রত করতে হবে। অবশ্যই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ করতে হবে দলগুলোকে।
সংবিধান জনগণের জন্য। সে কারণে সংবিধানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। নিজের স্বার্থের জন্য দেশের জনগণের উপর কোনকিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা।
শিক্ষাংগনকে সাময়িকভাবে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি মুক্ত রাখা এবং ছাত্ররাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তি বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে।
এখানে সব ধর্মের মানুষ একসাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সস্পর্কের মাধ্যমে বাস করে। পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে বলে আমার জানা নেই। এরপরও কুচক্রী মহল মিথ্যা রটায়। যেভাবেই হোক সব ধরনের প্রোপাগান্ডা নস্যাত করে আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। শিক্ষিত বেকার যুবক, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, পরিবেশ নষ্টকারীদের বিশেষ করে নদী ও পাহাড় কেখোদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
অন্যদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে ভারসাম্যপূর্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ। সীমান্তে আর কাউকে যেন প্রাণ হারাতে না হয়। ভারতের সাথে তিস্তাসহ সব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে কার্যকর চুক্তি ও তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে সবাই নিজেদের অধিকার নিয়ে নিরাপদে বেঁচে থাকবে। থাকবেনা কোন বৈষম্য, কোন অবিচার আর দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। থাকবেনা কোন জোরজুলুম, অনাচার। দেশের সব মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে নিজেদের দেশটাকে, প্রিয় মাতৃভমিকে গড়তে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট