যেকোন সংকটে ‘জাতীয় ঐক্য’ অপরিহার্য

1

সম্প্রতি সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচারের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের আহবানে রাজধানী ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মিলিত হয়েছিল প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতসহ নিবন্ধিত অনিবন্ধিত প্রায় ২০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা। সেখানে পার্শ্ববর্তী বন্ধুপ্রতীম ভারত বাংলাদেশের নাগরিক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে যেসব অপপ্রচার ও মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, এর তীব্র প্রতিবাদসহ দেশ বিরোধী যে কোন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় এবং দেশের বিদ্যমান সংকট কাটাতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন ড. মোহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ঐক্য আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী করতে হলে, পতিত আওয়ামীলীগ ছাড়া বাকি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে রাখার বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য।
সম্প্রতি দেশব্যাপী অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোতে রয়েছে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা। সংকট মোকাবিলায় সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে জোর আওয়াজ তুলছে। তবে কীসের ভিত্তিতে, কার সঙ্গে কাকে নিয়ে এ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হবে তা নিয়ে নানাজনের কথামালার মধ্যেই শেষ হলো জাতীয় ঐক্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ। আমরা মনে করি, জাতীয় ঐক্যের জন্য সংলাপ এখানেই শেষ হবে না। আরো সংলাপ ও ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন। এসব আলোচনায় ক্রমান্বয়ে সকলকে যুক্ত করাই হবে যুক্তিযুক্ত। একটি জাতীয় দৈনিকে জাতীয় ঐক্য নিয়ে মতামত ব্যক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি সব সময়ই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর ঐক্য ধরে রাখার ওপর জোর দিয়েছি। এ সাবধানবাণীও আমি দিয়েছি- ছোট-বড় বহু রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত শক্তিতেই হয়েছে গণঅভ্যুত্থান। এর সুফল ঘরে তুলতে হলে অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এদের ঐক্যটা ধরে রাখতে হবে। রূপ দিতে হবে জাতীয় ঐক্যের; তা না হলে বিপদ। ভুল বোঝাবুঝি যা হচ্ছে সেগুলো অনতিবিলম্বে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ফয়সালা করে রাজনৈতিক দলগুলোর এক ছাতার তলায় আসা জরুরি।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি জাতীয় ঐক্যের জন্য তাগাদা দিয়ে আসছেন দায়িত্ব নেয়ার শুরু থেকে। তাঁর সঙ্গে যখন যে দলের নেতারা দেখা করছেন- তাদেরই জাতীয় ঐক্যের আহŸান জানিয়েছেন তিনি। প্রবীণ নেতা সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম একজন ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন গত কয়েক যুগ ধরে। জেএসডি-জাসদ সভাপতি আ স ম রব জাতীয় ঐক্যের কথা বলেই যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এখন প্রধান উপদেষ্টার কাছে বড় দল বিএনপির প্রত্যাশাও জাতীয় ঐক্য। তাদের এ দাবির সঙ্গে ঘটা করে একাত্মতা জানিয়েছে আরেক প্রভাবশালী দল জামায়াতে ইসলামী।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষ্য- অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। যখন-তখন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন এবং বিশৃঙ্খলায় জননিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ অনিরাপদ বোধ করছেন। ধর্মীয় ইস্যু এবং হুটহাট দাবিতে কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে। শৃঙ্খলা না ফিরলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে-এমন চাপা শঙ্কায় ভুগছে বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অন্য দলগুলো। বিএনপির শঙ্কা এভাবে চলতে থাকলে অভ্যুত্থানের বৃহত্তম শরিক হিসেবে দায় নিতে হবে তাদেরও। নৈরাজ্য চললে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। তৃতীয় পক্ষ এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কিছুটা সংগঠিত হতে শুরু করায়, তারা এতে সমর্থন দেবে। আবার ছাত্র নেতৃত্ব যেভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মুখোমুখি করছে, তাও ক্ষতির কারণ হতে পারে। গত ২৭ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বিএনপি। জাতীয় ঐক্যের আহবান জানিয়েছে দলটি। প্রধান উপদেষ্টা এতে একমত হয়েছেন। সন্তুষ্টও হয়েছেন। পরের দিন বৃহস্পতিবার জামায়াত নেতারা যমুনায় সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহবানের সঙ্গে তারাও একমত। তিনি বলেন, আমরা একমত হয়েছি, দেশের সব মানুষকে নিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বিবৃতিতে চলমান পরিস্থিতিতে দেশের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহŸান জানিয়েছেন। জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, পরিস্থিতির ওপর সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখুন। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যাত্রাপথে ষড়যন্ত্রকারীদের বাধা বিচক্ষণতার সঙ্গে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হলে স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে চরম মূল্য দিতে হবে। তবে নেতারা ঐক্যের কথা বললেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা চলছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করছে। ঐক্যের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও তারা ষড়যন্ত্র করছে। ফিরে আসতে চাইছে। চট্টগ্রামে আইনজীবীকে হত্যা করে একটি সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর যে ষড়যন্ত্র জাতি দেখেছে, তাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার ইঙ্গিত বহন করে। এ সময়ে ঐক্যের ডাক ইতিবাচক। আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক দেশসমূহে যে ধারায় রাজনীতি চলে আমাদের ক্রমান্বয়ে সেইদিকেই ফিরতে হবে। দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে যেকোন জরুরি সংকট মোকাবেলায় ঐক্যের বিকল্প নেই-একথা দেরিতে হলেও যে বোধদয় হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে, তা অব্যাহত থাক।