ঐতিহাসিকভাবে ইহুদীরা কপট ও বিশ্বাসঘাতক। মহানবী (সা.) মদিনা হিজরতের পর মদিনাসনদ প্রণয়ন করে মদিনায় বসবাসরত সকল নাগরিককে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে একসাথে থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদীরা বারবার তাদের কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। এ ঘটনার তেরশ বছর পর আমরা জার্মান থেকে হিটলার কর্তৃক তাদের বহিষ্কার ও নিশ্চিহ্ন করার ইতিহাসও জানি। এমনকি যে ব্রিটিশ উপনিবেশ ইহুদীদের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র থেকে এনে ফিলিস্তিনের তেলাবিবে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছিল, সেই ব্রিটিশের সাথেও তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে ব্রিটিশ রাজ প্রসাদের দরজা তাদের জন্য এখনও বন্ধ। কথাগুলো প্রাসঙ্গিক বিধায় উল্লেখ করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহজুড়ে ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি আক্রমণ ও সংঘাতে লিপ্ত হয়। এতে দুইদেশই ভারি ও হাল্কা ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলের দীর্ঘদিন গাজা আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্ক করেছিল ইরান ইসরায়েলে হামলা করবে। তদুপরি মুসলিম বিশ্বে ইরানই একমাত্র দেশ যারা পরমানু শক্তিসম্পন্ন এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যুদ্ধ করার মত প্রস্তুতিও তার আছে। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় অধিকাংশ আরব ও পারস্য উপসাগরীয় দেশ সমুহকে তাদের পক্ষে টানতে সক্ষম হলেও ইরানকে কিন্তু সম্ভব হয়নি। ফলে ইরান নিয়ে ইসরায়েলের ভয় ও যুক্তরাষ্ট্রের সংশয় সবসময় ছিল। ইতোমধ্যে ইসরায়েল বিনা উস্কানিতে ইরানে হামলা করে দেশটির কয়েকটি সামরিক স্থাপনার ক্ষতিসহ প্রধান সামরিক কর্মকর্তা ও কয়েকজন কমান্ডারকে হত্যা করেছে। এর জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা করে ইসরায়েলকে সমোচিত জবাব দিয়েছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে ইরানকে উস্কানি দিতে থাকে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনার কথাও জানান। এরপরও বিশ্ববাসী এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করেনি। ডোনাল ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধে সে জড়াবে কি না, তা ভাবতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে দুই সপ্তাহ সময় নিবে। বিশ্ববাসী কিছুটা আশ্বাস্থ হয়েছিল, অনেকে আবার দ্বিধাদ্ব›েদ্বও ছিলেন, কারণ ট্রাম্প কখন কি করেন তা তিনি ছাড়া আর কারো বুঝতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। বাস্তবতাও তাই হল। দুই সপ্তাহ নয়, ঘোষণার দুইদিন পর কোনরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রর ১২৫ টি যুদ্ধ বিমান একযুগে ইরানে হামলা করে বসে। এতে ইরানের চারটি সামরিক ও ৩টি পারমনিবিক স্থাপনার ক্ষতি হলেও বাস্তবে বড় ধরণের কোন ক্ষতি ইরানের হয় নি। হামলার পর শান্তির দূত সহাস্যে বললেন, তাঁদের বাহিনী অত্যন্ত নিখুঁতভাবে হামলাটি পরিচালনা করেছে।
আর ট্রাম্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন গাজায় গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। অপরদিকে মার্কিন হামলাকে ‘নির্লজ্জ’ বর্ণনা করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইরান তার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সব বিকল্প খোলা রাখছে। আরাগচি বলেন, ‘কূটনীতির দরজা সব সময় খোলা থাকা উচিত, কিন্তু এই মুহূর্তে তা নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার দেশ হামলার শিকার হয়েছে, আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং আত্মরক্ষার বৈধ অধিকারের ভিত্তিতে আমাদের এর জবাব দিতে হবে। ’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ‘আন্তর্জাতিক আইনের অমার্জনীয় লঙ্ঘন’। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্য রাষ্ট্র। তাদের এই কর্মসূচি সব সময় নজরদারির মধ্যেই থাকে। অন্যদিকে এনপিটিতে সই না করা ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার জবাব ইরান কি আদৌ দিবে? এমন সব প্রশ্ন যখন ঘুরপাক হচ্ছিল তখন ইরান তার যুদ্ধ কৌশলকে বিস্তৃত করল মধ্যপাচ্যের কাতারে। সেখানে সবচেয়ে বড় মার্কিন যুদ্ধ বিমান ঘাটিতে হামলা করে বসে ইরান। এঘটনার পর যেই যেটাই ভাবুক, বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধাক্কা। বিচলিত ট্রাম্প কালবিলম্ব না করে ইসরায়েল ও ইরানকে যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত করানোর উদ্যোগ নেন। এ উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবতার মুখ দেখবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। এরপরও বিশ্ব সম্প্রদায় আশা করে, যুদ্ধ এখানেই থামাতে হবে। ইসরায়েলকে সংযত হতে হবে। গাজায় তাদের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।
আমরা লক্ষ করেছি, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। পাশাপাশি খোদ মার্কিন রাজনীতিকদের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এই হামলাকে মার্কিন সংবিধানের চরম লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও বলেছেন, ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য নেতানিয়াহু অনেক আগে থেকেই ইরানে হামলা করতে চাচ্ছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই হামলার কারণে চলমান ‘সংঘাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পক্ষে বড় ধরনের ঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখন্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানো দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিজিটিএন প্রশ্ন তুলেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও ইরাকে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি ইরানে করছে? একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আরো অনেক দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিকে আরো বিপদগ্রস্ত করবে। জ্বালানি তেলের দাম এরই মধ্যে অনেক বেড়েছে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে তা আরো সংকট সৃষ্টি করবে। অর্থনৈতিক মন্দা ব্যাপকতর হবে। তাছাড়া এটি নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।