যুদ্ধ নয়, শান্তির পক্ষে হোক তার পদক্ষেপ

3

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোড়িত ও আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হয়েছে গত ৫ নভেম্বর মঙ্গলবার। এ নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের মাধ্যমে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মসনদ দখল করলেন। সেইসাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিশ্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ জয়কে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে নির্বাচনকালীন তাঁর দেয়া যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতির প্রতি মুখিয়ে আছে। ব্যক্তিজীবনে একজন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক ট্রাম্পের চারিত্রিক ও আচরণিক বৈপরিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নানা সমালোচনা করলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের ব্যাপারে নমনীয় ছিলেন সবসময়। একইসাথে তার মানবিক সত্তার বিশালত্বের কথাও বিশ্ববাসীর জানা আছে। তবে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো ট্রাম্পের এ জয়কে সতর্কতার সাথে অভিনন্দিত করেছেন। চীন, রাশিয়া ও উত্তর কুরিয়ার সাথে তাঁর বুঝাপড়া কিরকম হয় তা দেখার অপেক্ষায় থাকবে বিশ্ববাসী।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন এবং ট্রাম্প ফিরিয়ে আসার দিনটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আড়াইশ’ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছিল আরেকবার। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড চার বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৮৮৮ সালে হেরে যান। ঠিক চার বছর পর ১৮৯২ সালে আবার নির্বাচনে জিতে তিনি ফেরেন হোয়াইট হাউসে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে ১৩২ বছর পর সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা অবশ্যই সবচেয়ে নাটকীয় ফিরে আসা। ৭ কোটি ১০ লাখের বেশি মার্কিনির ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমেরিকানদের মধ্যে বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচনে স্পষ্টতই পক্ষ ছিল দুটি। এক পক্ষের কাছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি ও নারী অধিকার। এই ভোটারদের ভোট বেশি পড়েছে কমলা হ্যারিসের পক্ষে। অন্যদিকে, মার্কিন অর্থনীতি ও অভিবাসী সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিনীদের ভোট পড়েছে ট্রাম্পের পক্ষে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বব্যাপী মার্কিন নীতির প্রভাব সর্বজনবিদিত। দেশটির ক্ষমতার পালাবদলে পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে, ট্রাম্পের নেতৃত্বে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কেমন হবে, এটি এক বড় প্রশ্ন। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে রাতারাতি বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। গণতন্ত্র ও উদারনীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে সুনাম তা নিশ্চয়ই আগামী দিনে বৃদ্ধি পাবে। সুসম্পর্কের প্রত্যাশা করছে বহু দেশ। মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিল তা থেকে বেরিয়ে আসবে আগামী দিনের যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এ নির্বাচনের সৌন্দর্য হলো, কোনো পক্ষ থেকেই কোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি এবং মার্কিন নাগরিকরা যাকে যোগ্য মনে করেছেন তাকেই রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসাতে পেরেছেন। গত বছরের শুরুতে সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্প লিখেছিলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে থাকলে তিনি এক দিনের মধ্যেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধ করতেন। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা হস্তগত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। আশার কথা, নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর প্রদত্ত ভাষণেও তিনি বলেছেন, তাঁর আগের মেয়াদে যেমন কোথাও যুদ্ধ বাধাননি, তেমনি এ মেয়াদের কোথাও যুদ্ধ থাকবে না। নির্বাচনী প্রচারণায় রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। ইসরায়েলপ্রীতি সত্তে¡ও তিনি এবার মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বন্ধে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা মনে করি, বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রের কর্ণধাররূপে ট্রাম্প আগামী দিনগুলোতে ওই প্রতিশ্রæতিসমূহ রক্ষা করলে বিশ্ব ক্রমশ অগ্রসর হবে শান্তির দিকে। সেই সাথে ভারতের সাথে তাঁর প্রীতিময় সম্পর্ক আরো জোরদার হবে-এমনটি আভাস আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাকালীন তাঁর উদ্বেগের কথা আমরা শুনেছি। এরপরও বাংলাদেশ আশা করে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক অব্যাহতই থাকবেনা, বরং আরো উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসীবিরোধী বলে পরিচিত। তিনি দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ ও মেক্সিকানসহ অভিবাসী জনগোষ্ঠী স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ৩০ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন। যার ভেতর বৈধ ও অবৈধ উভয়ই রয়েছেন। স্বভাবতই অবৈধরা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা আশা করব, যুক্তরাষ্ট্র যে একটি অভিবাসীর দেশ এবং তাদের অবদানেই দেশটি আজকের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, এ গূঢ় সত্য অনুধাবন করবেন ট্রাম্প। সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বীর মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ভবিষ্যৎ ট্রাম্প প্রশাসন। এমনটাই প্রত্যাশা বিশ্ব সম্প্রদায়ের।