যুদ্ধের পর যুদ্ধ হয় বেসামাল

1

মিঞা জামশেদ উদ্দীন

এমনিতে প্রকৃতিতে বৈরী হাওয়া বইছে। বাতাসে আর্দ্রতা ও উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকেছে। বৈশাখের শেষাবধিতে এমন প্রখর তাপদাহ হবে বলে মনে করি নি; বেঘোরে ভরদুপুরে বের হয়ে মহা মুশকিলে পড়ি। রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠি। রাত ৮টার দিকে তড়িঘড়ি করে ঘরে ফেরা হয়। চট্টগ্রামে উপশহর সীতাকুন্ড। বর্ধিত শিল্পায়ন ও নগরায়নে প্রচন্ড প্রভাব পড়ে প্রকৃতিতে। বিশেষ করে সীতাকুন্ড বাজারে নয়া-নয়া মার্কেট, দালান-কোটা নির্মাণে হিড়িক পড়েছে। এখন অলিগলি ও সরু জায়গাও দখল করে চলেছে ভূমিদস্যুরা। এতে করে নির্বিচারে গাছ কর্তন করে শ্মশান ভ‚মি করেই ছাড়ছে। এমতবস্থায় কোথাও একখন্ড শীতল ছায়া মিলছে না। এমন হাঁসফাঁস অবস্থায় প্রথমে ঝুমঝুমিয়ে ভিজে নিই। তবুও প্রশান্তি মিলছে না। এভাবে রাত কাটে। তারমধ্যে পাক- ভারত যুদ্ধে ডামাডোল বেজে ওঠে। টানা ৪দিন চলে এ যুদ্ধ। একে অপরের ওপর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এবার কিন্তু পাক-ভারত যুদ্ধ জল ও স্থলে সীমাবদ্ধ ছিল না। আকাশ থেকে আকাশে চলে ড্রোন হামলাও। এ যুদ্ধে দুই দেশের অর্থনীতি নয় শুধু, প্রকৃতির উপরও বিরূপ প্রভাব পড়ে। বেড়ে যায় প্রকৃতিতে এ-উষ্ণতা। অন্যদিকে যুদ্ধে জড়ানো নিয়ে স্বদেশে চলছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য-ভর্ৎসনা, খোদ নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী ও অমিত শাহের উপস্থিতিতে। তাঁরাও নির্বিকার, মুখে কোনো সাড়া- শব্দ নেই, ক্ষাণিকটা বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।
এক সভ্য নারী বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহা নড়েচড়ে ওঠলে, সঙ্গে সঙ্গে হাতের ইশারায় পুনরায় দমকিয়ে বসুন বলে থামিয়ে দেয় ওই নারী। তিনিও অগত্যা স্ব আসনে বসে পড়েন। ওই নারী ওইভাবে বসিয়ে দেয়ার এখতিয়ার আছে কিনা জানি না; স্বয়ং যেখানে স্পীকার উপস্থিত আছেন, সেখানে এভাবে বলা কতটুকু শোভনীয়! তারপরও থেমে নেই প্রতিবাদ।
‘এক চা ওয়ালা’, এভাবে বহুবার টানা বলতে মোটেই কার্পণ্যবোধ করেন নি প্রতিপক্ষ-বিরোধীদলের সভ্যরা! আরেক সভ্যতো কবুতরের ডানা ঝাঁপটানোর মত অঙ্গভঙ্গিসহকারে বলতে থাকে, ‘কিত-কিত-কিত, কিত-কিত-কিত, কিত-কিত-কিত’। যুদ্ধ নিয়ে ভারতের লোকসভা উত্তপ্ত এবং সমানভাবে ভর্ৎসনা চলছে। তাঁদের অঙ্গভঙ্গি ও আচরণে উপস্থিত সভ্যগণও হা-হা, হু-হু, মুখ চিপে হাসতে থাকেন। এমন পরিস্থিতি শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, সমগ্র বিশ্বে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক স্ব-গরম চলছে। একেবারে গ্রামের চায়ের স্টলে গরম-গরম চা খেতে খেতে ধোঁয়া উঠছে বেমালুম। কোনভাবেই আমজনতা থামাথামির-ব্যপারস্যাপার নেই। তাদের বিচার-বিশ্লেষণ ও ধারণাকে হালকা ভাবা যায় না। এখন নেট দুনিয়া। সকলের হাতে হাতে এনড্রোয়েট সেট। মুহূর্তে আলোবর্ষন-গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে ঘটনার পর ঘটনা। আমাদের দেশের আমজনতাও এর ব্যতিক্রম নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম পন্থিদের অবস্থানও সমানে সমান। কেউ পাকপন্থি, আবার কেউ ভারত পন্থি। অনেকটা ৩০-৩৫ শতাংশ জনমত দেখা মিলে। অবশিষ্ট ৫ শতাংশ কোনো পক্ষের নয়; আর যাঁরা আছেন, তাদের ছেঁদভেদ বলতে কিছুই নেই। তবে বাংলাদেশ ভাটির অঞ্চলের, জোয়ার-ভাটার দেশ। প্রকৃতির মত এ অঞ্চলের মানুষের স্বভাব। এ-উত্তাপ এ-শীতল। তবে বিশ্বের সমীকরণ ছিল ভিন্ন, পাক-ভারত যুদ্ধ নিয়ে। তারা একচ্ছত্র অস্ত্র বিক্রেতা এবং এভাবে হারজিতও দেখে।
তবুও সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান রাফাল এ-হার! রীতিমতো ফ্রান্সের মাথায় হাত। চীন সেখানে একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেই ছাড়ে। তারা সুপার সনি, অর্থাৎ এ প্রজন্মের হাই বোল্ডের রাফাল যুদ্ধবিমান পাকিস্তানকে সরবরাহ ও যোগাযোগ দেয়। চীনের ছিল এটি পরীক্ষামুলক। সফলতা এসে যায় তাদের হাতের মুঠোতে। বিশ্ব বাজারে চীনের সমরাস্ত্রেরও কদর বেড়েছে। তবে অস্ত্রের বিশাল মার্কেট রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে, যেখানে পশ্চিমারা পতিনিহিত বৈরী আচরণ করচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর সাথে। বিশেষ করে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর এবং ইসরায়েলের নারকীয় গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে। সেখানে একমাত্র ভরসা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র, পাকিস্তানকেও চীন সকলপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে এসেছে। অর্থাৎ মুসলিম দেশগুলো চীনের সমরাস্ত্রের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। বলতে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের এ থাবা পশ্চিমারা ভালো চোখে দেখছে না।
পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে নাটকীয়তারও শেষ নেই। ১০ মে ২০২৫ সন্ধ্যায় ৬ টা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে অর্থাৎ ১০মে ২০২৫ইং পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপরেশন ভারতের ডিরেক্টর জেনারেলকে টেলিফোনে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ওইদিন বিকাল ৫টা থেকে। অবশ্য ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের এ ঘোষণার আগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ শেয়ার করা এক পোস্টে উল্লেখ করেন। এ যুদ্ধবিরতির জন্য তিনি সারা রাত আলোচনার পর সফল হয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তা যে হয়েছে, কোনভাবেই তা অসত্য বলা যাবে না। তবে এ যুদ্ধ দ্বিতীয় দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত গড়ায়। এতে ভারতের সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে পাক ডিরেক্টর জেনারেল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়, যেহেতু মার্কিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনা পরও তাদের দিক থেকে যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। মোদ্দাকথা, পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির হওয়ায় এ উপ-মহাদেশে শান্তির বাতাস বইতে থাকে। অবশ্য এতেও কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। চির বৈরি নয়, দুই দেশ-ই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। যুদ্ধ আরো দীর্ঘ-সময় ধরে গড়ালে সাধারণ লোকজনের জীবনহানি ও জানমাল নিয়ে জুয়াখেলা হতো, অর্থাৎ তারা হতো বলির পাটা। আরেকটি কথা না বললে নয়, রাষ্ট্র দুটি পারমাণবিক শক্তি হলেও অন্যান্য প্রযুক্তি-প্রতিরক্ষা ও শিক্ষাদীক্ষা এবং অর্থনৈতিকভাবে যোজন যোজন মাইল পিছিয়ে আছে। তাদের যুদ্ধবিগ্রহ বাদ দিয়ে দেশ গড়ার মনোনিবেশে হওয়া উচিত বা আরো সচেষ্টতা দেখাতে হবে। যতসব হালকা বিষয় নিয়ে এ-যুদ্ধবিগ্রহে জড়ানো উচিত নয়। বাড়াতে হবে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও নাগরিক অধিকার এবং পরমধর্ম সষ্ণিতা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ উদ্যোগকে সাদুবাদ দিতে হয়। অন্তত বিশ্ব একটি পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেল। কোনোনা কোনোভাবেই এ যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিলে তা দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে দাঁড়াতো। তবে একমাত্র জাপানই যথেষ্ট এ পারমাণবিক যুদ্ধের দৃষ্টান্ত। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্ষেপকৃত পারমাণবিক বোমার ক্ষতবিক্ষত এখনো জাপন বহন করে চলেছে। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে এখনো বিকলাঙ্গ জন্ম নেয়। হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্কোর ভাঙতে চায়নি; অবশ্য এ কথা বলার কারণও আছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা করতে যান। সেখানে ভলোদিমি জেলেনস্কিকে হেনস্থ হয়ে ফিরতে হয়। ২০২২ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ায়। সেখানে চরম খেসারত দিতে হচ্ছে ইউক্রেনকে। তাদের অপরাধ নেটো ভুক্ত হতে চেষ্টা করা। অবশ্য রাশিয়া তাঁদের নিরাপত্তার খাতিরে ইউক্রেনকে কোনোভাবেই নেটো ভুক্ত দেশ হওয়া চাই না। এখনো দেশ-দুটিতে যুদ্ধ চলমান রয়েছে। ইচ্ছে করলে সেদিন ভলোদিমির জেলেনস্কিকে আশ্বস্ত করে একটি প্রস্তাবও দিতে পারতেন এবং নেটোভুক্ত হওয়া প্রস্তাবনা থেকে সরে আসতে। সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথেও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবনা রাখতে পারতেন। একইভাবে ইরান ও ইসরায়েল মধ্যে চির বৈরীতারও ইতিটানা যেতে পারে। সঙ্গে নিরীহ ফিলিস্তিনির ওপর ক্রমাগত হামলা, হত্যাযজ্ঞ এবং অধিকতর দখল বন্ধ করার প্রচেষ্টার উদ্যোগ নিতে পারতেন। অথচ সেক্ষেত্রে কোনো প্রদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এ পর্যন্ত নারী-শিশুসহ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। গাজা উপত্যকাসহ রাফা শহরের জনবসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ফিলিস্তিনিদের ওই শহরে দখলদার ইসরায়েল বাহিনী ৩টি করিডর স্থাপন করে দখল অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ বলতে হয় ইতিহাসের আলোকে, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা ভালো না। হামাসসহ অপরাপর ফিলিস্তিনিদের গোষ্ঠীগুলো এখনো-ভাবে আবাবিল পাখি এসে তাদের পক্ষে নিবে এবং ধ্বংস করবে দখলদার ইসরায়লদের। হামাসের প্রথম হামলায় প্রায় ১১শ ইসরায়েল প্রাণ হারায়। তার বিপরীতে ইসরায়েল অব্যহত হামলায় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারালো এবং জন্মভূমি হারিয়ে উদ্বাস্তু জাতিতে পরিণত হলো।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলামিস্ট