যুগোপুরুষোত্তম শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

2

উত্তম কুমার চক্রবর্ত্তী

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি পাবনা জেলার হিমায়েতপুর গ্রাম, পুণ্যসলিলা পদ্মা দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ছুটে চলেছে অনন্তের মহাসাগরে। সবুজের সমারোহ আর নয়নাভিরাম প্রকৃতির প্রাণজুড়ানো সেই গ্রামে আবির্ভূত হয়েছিলেন যুগোপুরুষোত্তম শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বাংলা ১২৯৫ সালের ৩০ ভাদ্র শুভ তালনবমী তিথিতে। সমস্যা সংকুল পৃথিবীতে মানুষের বহুমুখী সমস্যা সমাধানে শ্রীশ্রী ঠাকুর প্রবর্তিত সৎসঙ্গ আজ এক বিশ্বনন্দিত অনবদ্য প্রতিষ্ঠান। মানুষের জীবনের প্রতিটি স্তরে ধর্মকে জীবন্ত ও মূর্ত করে তোলাই ছিল শ্রীশ্রী ঠাকুরের অন্তরের বাসনা। তাইতো তিনি বলেছেন-
‘ধর্ম যদি নাইরে ফুটলো / জীবন মাঝে নিত্য কর্মে
বাতিল করে রাখলি তারে / কী হবে তোর তেমন ধর্মে।’
জগতে মহামানবদের আবির্ভাব যেন মানব কল্যাণের জন্যে। মানুষকে ভালবাসার মাধ্যমে শ্রীশ্রী ঠাকুর সকলের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির এক মহা সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন। উচ্চ বিদ্যালয়ের লেখাপড়া করা অবস্থায় নিজে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়েও পরীক্ষার ফরম পূরণের ফি একজন দরিদ্র বন্ধুকে প্রদান করে এক অনুপম মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। অন্যের উন্নতি কামনায় পরীক্ষা দেওয়া হলো না তাঁর। অতঃপর মায়ের ইচ্ছাপূরণে তিনি ছুটে গেলেন ডাক্তারি পড়তে কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে। আর্থিক সংকটে থাকা সত্তে¡ও সবার প্রতি মনোমুগ্ধকর ব্যবহারের স্বীকৃতিস্বরূপ ডাক্তার হেমন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় ঔষধসহ তাঁকে একটি ডাক্তারি বাক্স উপহার দেন। আর তা দিয়ে তিনি কয়লার গুদামের কুলি-মজুরদের সেবা শুরু করেন। এইভাবে ছাত্রজীবনে ডাক্তারী পড়া সেবার আনন্দের মধ্যে কেটে গেল। ডাক্তার হয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুর ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। অভূতপূর্ব সাফল্যে অন্যান্য ডাক্তারদের আয় রোজগারের পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে শ্রীশ্রী ঠাকুর তাদের কষ্ট লাগবে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিলেন। মানুষের মানসিক ও আত্মিক চিকিৎসার কাজে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সমাজের অসহায় অবহেলিত নিপীড়িতসহ সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে গঠন করলেন কীর্তনের দল। কীর্তন আনন্দে মাতিয়ে তুললেন চারিদিক। যেন ঠাকুরের অন্তরে বেজে উঠল-
আমি ঢালিব করুণা ধারা,
আমি ভাঙ্গিব পাষাণকারা।
অনির্বচনীয় তাঁর মহাভাব, সেই অলৌকিক নাম সংকীর্তনের প্রভাবে প্রকৃতি স্পন্দিত হয়ে উঠল। গ্রাম সহ দূর দূরান্ত থেকে যোগ দিলেন অনেকে তাঁর কীর্তনের দলে। মহাপ্রভু যেমন শ্রীবাসের আঙ্গিনায় শুরু করেছিলেন প্রথম মহানাম সংকীর্তন ঠিক তেমনি শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁরই পার্ষদ কিশোরী মোহনের আঙ্গিনাকে করেছিলেন মহাসংকীর্তনের কেন্দ্রস্থল। কীর্তন করতে করতে পরম ভাবাবেশে শ্রীশ্রী ঠাকুর সংজ্ঞা রহিত হয়ে পড়ে যেতেন মাটিতে। দেহে বহু প্রকার আসন মুদ্রাদি হতো। ভাব সমাধিস্থ অবস্থায় তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে বের হতো বিভিন্ন ভাষায় সৃষ্টিতত্ত¡, অবতারতত্ত্ব, ধর্ম, জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম সম্বন্ধীয় এবং নাম মাহাত্ম্য সহ মহাউদ্ধারণ বাণী। যার মাত্র ৭২ দিনের ভাববাণী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘পুণ্যপুঁথি’ নামক পবিত্র গ্রন্থ।
শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁর ভাববাণীতে নামসংকীর্তন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন: ‘কীর্তনের একটি শক্তি আছে জোর করে মনকে উচ্চে নিয়ে যায়-তাই মহাপ্রভুর কীর্তন প্রচার।’ আমরা জানি তরঙ্গ দেখতে গেলে সাগরে যেতে হয় আর সেদিন শ্রীশ্রী ঠাকুরের নাম সংকীর্তনের প্রেমের তরঙ্গ দেখেছিলেন ভক্ত কিশোরী মোহন, অনন্তনাথ, সতীশ গোসাই সহ অসংখ্য ভক্তবৃন্দ। মানুষের বহুবিদ সমস্যা সমাধান কল্পে আস্তে আস্তে হিমায়েতপুরে গড়ে তুললেন সৎসঙ্গ আশ্রম, বিশ্ব বিজ্ঞানকেন্দ্র, তপোবন বিদ্যালয়, মনমোহিনী ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজী, সৎসঙ্গ কেমিক্যাল ওয়ার্কস, সৎসঙ্গ কলাকেন্দ্র, সৎসঙ্গ প্রিন্টিং প্রেস, দাতব্য চিকিৎসালয় সহ কল্যাণমূখী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি জাগতিক জীবনকে যাতে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারে সেই লক্ষ্যেই শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁর মহাজীবনে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। পরা ও অপরাবিদ্যার মহা সুসমন্বয় স্থাপন করেছেন তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মে। মানুষের কল্যাণের জন্য অসংখ্য গ্রন্থে দিয়েছেন তিনি বহুবিধ সমস্যার সমাধান। শ্রীশ্রী ঠাকুরের সত্যানুসরণ, পুণ্যপুঁথি, চলার সাথী, নারী নীতি, নানা প্রসঙ্গে, কথা প্রসঙ্গে, বিবাহ বিধায়না, শিক্ষা বিধায়না, বিজ্ঞান বিভূতি, বিজ্ঞান বিধায়না, সমাজ সন্দীপনা, ইসলাম প্রসঙ্গে, অনুশ্রæতি (সাত খন্ড), নারীর পথে, দর্শন বিধায়না, তপোবিধায়না, স্বাস্থ্য ও সদাচার সূত্র, আচার-চর্য্যা, ঞযব গবংংধমব (৯ খন্ড) সহ বহুবিধ গ্রন্থে মানুষের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উন্নতির সমাধান বাণী খুঁজে পাওয়া যায় অতি সহজে। শ্রীশ্রী ঠাকুরের মানব কল্যাণমুখী কর্মকাÐ দেখতে পাবনার হিমায়েতপুরে ছুটে গিয়েছিলেন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী সহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসেছিলেন ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, কথা সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপ্যাধায়, সাহিত্যিক বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়। তিনি সৎসঙ্গের কার্যক্রমের যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরকে গুরুপদে বরণ করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পিতা জানকী নাথ বসু ও তাঁর মা প্রভাবতী দেবী, কথক কবি হেমচন্দ্র, কবি কান্তি ঘোষ, নাট্যকার যোগেশ চৌধুরী, পদার্থ বিজ্ঞানী কৃষ্ণ প্রসন্ন ভট্টাচার্য্যসহ অনেকে। শ্রীশ্রী ঠাকুরের এই বিশাল সৃষ্টিকর্ম মানুষের সর্বোত্তমুখী উন্নয়নের এক মহাকর্মযজ্ঞ। তিনি প্রেম ভালবাসার মূর্ত বিগ্রহ। তাইতো ঠাকুর বললেন- ‘ভালবাসার টান কর্মে আনে সফলতা, জীবনে উত্থান।’ ধর্ম, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে জীবন বৃদ্ধির প্রাণবন্ত বাণীর সমাবেশ রয়েছে তাঁর অমর সৃষ্টিকর্মে। এখনো পর্যন্ত অনেকে শ্রীশ্রী ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্যকর্মের উপর গবেষণা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিচ্ছেন পিএইচডি ডিগ্রী। তাই বলবো শ্রীশ্রী ঠাকুর জীবন বৃদ্ধি আন্দোলনের এক মহান নেতা, মহাপুরুষ। শ্রীশ্রী ঠাকুর কুসংস্কারের পাষাণকারা ভেঙ্গে করুণার মহাকাশ থেকে নিখিল প্রাণগঙ্গার মঙ্গল ধারা ঢেলে গেছেন মানব মুক্তির জন্যে। সৎসঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে এক সার্থক নবজাগরণ। মহৎ ভাবনা অধিকারী হয়ে নিজের জীবনচর্যায় পরম সত্যে প্রতিষ্ঠিত থেকে কিভাবে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শ্রীশ্রী ঠাকুর। তাইতো তিনি বললেন-
‘সৎ যদি হয় সঙ্গ তোমার / ভাব যদি মহান উচ্চ,
বিশ্বের তরে সাধনা তোমার / হবে না ব্যর্থ, হবে না তুচ্ছ।’
তাঁর লীলায়িত মহাজীবন লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। কর্মব্যস্ত জীবন চলার যাত্রা পথে প্রিয়পরম বাঁচা বাড়ার পঞ্চনীতি, যজন-যাজন, ইষ্টুভূতি, স্বস্তয়িনী ও সদাচারের অমোঘ মন্ত্র প্রদান করে সুষ্ঠু পরিবার ও সমাজ গঠনের পথকে করেছেন সুগম। হিমালয়ের কঠিন কঠোর সাধনাকে গৃহাশ্রমের মধ্যে এনে মানুষকে দেবতার গুণসম্পন্ন করতে অমৃত বাণীর আলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গ তাই জীবন বৃদ্ধি আন্দোলনের প্লাটফর্ম। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানুষ কীভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হবে তার যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি হিমায়েতপুর ও দেওঘরে গড়ে তোলা বিভিন্ন মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠান ও তাঁর লিখিত অমিয় গ্রন্থাবলীর মাধ্যমে। তালনবমীর এই শুভ জন্ম তিথিতে প্রিয় পরমের শ্রীচরণে জানাই প্রণাম। তাঁর আদর্শ আমাদের চলার পথে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকুক চিরকাল। প্রত্যেকের জীবন হোক মঙ্গলময়, আনন্দময় ও ইষ্টপ্রাণতায় সমৃদ্ধ, এই প্রার্থনা। ‘বন্দে পুরুষোত্তম্।’
লেখক : প্রধান শিক্ষক, ধর্মীয় বক্তা ও প্রাবন্ধিক