যুগের ইমাম গাজ্জালী অধ্যক্ষ আল্লামা মুসলেহ উদ্দিন (র.)

1

মোহাম্মদ শাহজাহান

এ বসুধায় ক্ষণে ক্ষণে প্রত্যহ কত মানব-মানবীর আগমন-প্রস্থান ঘটছে! ক’জনকেই বা আমরা স্মরণে রাখি? সবাই স্বীয় নাম ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে না পারলেও কদাচিৎ এমন কিছু ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে ,যাঁরা তাঁদের দেদীপ্যমান কীর্তি, দীপ্তময় কর্মকান্ড আর বহুমুখী বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এমনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন গজ্জালিয়া জামান অধ্যক্ষ আল্লামা মুছলেহ উদ্দিন (রাহমাতুল্লাহ আলাই)। যিনি নিষ্কলুষ- পঙ্কিলমুক্ত ও জৌলুশহীন পার্থিব জীবন, চারিত্রিক মাধুর্যতা এবং অনুপম আমানতদারিতার জন্য সবার হৃদয় মানসপটে চিরজাগরুক হয়ে আছেন । তিনি ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত জোয়ারা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী আব্দুল আজিজ আর মাতার নাম রহিমুন্নেসা। হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে ১৯৫৪ সনে দাখিল, গারাংগিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে১৯৫৬সালে আলিম, দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে১৯৫৮ সালে মেধা তালিকায় ১৪ তম স্থান নিয়ে ফাজিল ও ৬ষ্ঠতম স্থান নিয়ে ১৯৬০ সালে কামিল পাস করেন। আবার ১৯৬২ সালে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি.১৯৬৪ সালে সিটি কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং ১৯৬৬ ও১৯৬৮সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ইতিহাস ও আরবিতে কৃতিত্বের সাথে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেনষ জোয়ারা ইসলামিয়া, সীতাকুন্ড আলিয়া ও পটিয়া হাইদগাও মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মময় জীবনের সূচনা হয়।
১৯৬৪সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, তৎপরবর্তী থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছোবহানিয়া কামিল মাদ্রাসায় তাঁর কর্মময় জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অধ্যক্ষ পদে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করলেও ছাত্রদের পাঠদানের বিষয়ে তিনি কখনো কার্পণ্য করেননি। ২০০৯ সালে কয়েক বছরের জন্য চট্টগ্রাম নেসারিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিসের দরস দেন। ১৯৭৮/৭৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নৈশকালীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কিছুদিন নিয়োজিত ছিলেন। ঐ কলেজ সরকারি করণ করা হলে তাঁকে হয়তো মাদ্রাসা না হয় কলেজ কোন একটি চাকরি বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়। তিনি সানন্দে কলেজের চাকুরী ত্যাগ করে মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। এমন কোন বিষয় ছিল না, যে বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন না। বৈষয়িক জ্ঞানের পান্ডিত্যের পাশাপাশি ফতোয়া- ফারায়েজ, রাজনীতি, ধর্মনীতি, আন্তর্জাতিক ও সমসাময়িক ইসলামী শরীয়তের জটিল সমস্যাবলীর উত্তম সমাধানকারী এবং বাংলা, উর্দু, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি সহ বহু ভাষাবিষারদ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন বলে তিনি যুগের ইমাম গাজ্জালী উপাধিতে ভূষিত হন। দর্শন বিষয়ে ব্যুৎপত্তির জন্য ছাত্ররা তাঁকে সক্রেটিস হিসাবে আখ্যায়িত করতেন।এত উঁচু মাপের মহাজ্ঞানী হয়েও তিনি অতি সাধারণ, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবনযাপন করতেন। বাহারুল উলুম, আমানতদার ও মোত্তাকি বুজুর্গ হিসাবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত ছিলেন। সমসাময়িককালে মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল তাঁর জীবনের পরমব্রত। “রাহমাতুল্লিল আলামিন”, “ইসতিজার আলা ত্তা’আত “সহ বেশ কিছু কিতাব তিনি রচনা করেন। মাওলানা আব্দুল মান্নান(ম:জি:আ): কর্তৃক অনুবাদকৃত বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ কানযুল ঈমান এর নিরীক্ষণ কার্য ও তিনি সমাধা করেন।(যা মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল হয়েছেন বলেই স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর ইন্তেকালের কয়েক দিন পূর্বে হসপিটালে রাত তিনটায় তিনি ছরকারে দো ‘আলম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আ ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি কে জাগ্রত অবস্থায় দেখে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় ও দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন এবং মহিউদ্দিন নামক এক ছাত্রকে বলছিলেন- আমাকে দাঁড় করিয়ে দাও, আমার টুপি দাও, লাঠি দাও, আমার হুজুর এসেছেন, আ’লা হজরত এসেছেন)। তিনি ১৯৮২ সালে গঠিত ‘জামাতে আহলে সুন্নত বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় পরিষদের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যে পরিষদের সভাপতি ছিলেন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী(রহ:)। তিনি ২০০৩ ও
২০০৫ সালে জাতীয় শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসাবে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক লাভ করেন। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির অনন্য রূপকার ছিলেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বতন্ত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জমাত কমিটি গঠন, কামালে ইশকে মোস্তফা কমপ্লেক্স,লালদীঘি জামে মসজিদ নির্মাণসহ অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দাবি আদায়ে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন প্রায় এক যুগ পর্যন্ত । তাঁর জ্ঞানের বিশালতার কাছে সমকালীন যুগের বিজ্ঞ আলেমগণ ছিলেন শ্রদ্ধাস্পদ ও অবনত মস্তক। সত্যকথন আর নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। গারাঙ্গিয়া ও ফুরফুরা মুজাদ্দেদিয়া দরবারের খেলাফত প্রাপ্ত ছিলেন তিনি।২০১২ সালের ২১ শে জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন।চকবাজার ধোনিরপুল ফালাহ গাজী মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
ছোবহানিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা