যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বে বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা, তারপরও বাংলাদেশ পশ্চাতে

1

এডভোকেট সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু

উত্তর আমেরিকা মহাদেশে অবস্থিত প্রশান্ত এবং আটলান্টিক মহাসাগর পরিবেষ্টিত ৫০টি অঙ্গরাজ্য, ১টি জেলা, ৫টি অঞ্চল ও কিছু ক্ষুদ্র বহিঃস্থ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র। ৩৭ লক্ষ ৯৬ হাজার মাইল বা ৯৮ লক্ষ ৩৩ হাজার ৫১৬ কি.মি. আয়তনের যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ অবৈধ প্রায় ৭/৮ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বসবাস করে। এখানে বাংলাদেশি ভোক্তাদের দেশীয় পণ্যের চাহিদা প্রচুর। হস্তশিল্প, কারুশিল্প, প্লাস্টিকসামগ্রী, শুটকি, হিমায়িত মাছ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্যাকেটজাত নানা ধরনের মশলা, তাছাড়া সরিষার তৈল, নারিকেল তৈল, ঘি, দেশীয় শস্য, আলু, চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সুজি, রুটি, পরটা ও বাংলাদেশের উৎপাদিত ফল। দেশীয় হিমায়িত গরু, মহিষ, ছাগল, হাস ও মুরগির মাংস ইত্যাদির যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের কাছে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি ভোক্তাদের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্তে¡ও এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সহজে পাওয়া যায় না। এখানে বাংলাদেশিদের কাছে দেশীয় মিঠা ও সামদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশি মালিকানাধীন দোকানপাটে সবসময় মায়ানমার ও ভিয়েতনামারে উৎপাদিত মিঠা পানি হিমায়িত রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, কৈ মাছ পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে উৎপাদিত এসব মাছ পাওয়া যায় না। তবে সীমিতভাবে দেশীয় মিঠা ও সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির হিমায়িত ছোট মাছ পাওয়া যায়। এখানে অধিকাংশ সময়ে হিমায়িত ইলিশ মাছের দেখা মেলে। কিছু সীমিত সংখ্যক স্কয়ার, ওয়েল ফুড, বোম্বে সুইটস ও প্রাণ কোম্পানির সামগ্রী পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্য বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সরকারের উদাসীনতার কারণে বাজার হারিয়ে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ও মধ্যপ্রচ্যে বসবাসরত মুসলিম স¤প্রদায়ের কাছে হালাল পণ্যের চাহিদা প্রতিনিয়ত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে দেখা যায়, শুধু মুসলমান নয়, প্রায়শঃ ইংরেজরাও হালাল রেঁস্তোরাতে এসে খেতে দেখা যায়। ফলে শুধু মুসলিম স¤প্রদায় নয়, অন্যান্য স¤প্রদায়ের কাছেও হালাল খাবারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। তথ্য অনুসারে, প্রায় ৫০ লাখের অধিক মুসলমান জনগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে। এখানে বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম স¤প্রদায়ের হালাল হোটেল, রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক ব্যতীত বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং দোকানপাট খুবই সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া রাজ্যে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অনেক হালাল রেস্তোরাঁ রয়েছে। তাদের সেখানে হালাল ব্যবসা বাণিজ্য দখলে রয়েছে। আর এ রাজ্যে বাঙালি হোটেল, রেস্তোরাঁ দোকানপাট হাতেগোনা কয়েকটি দেখা যায়। আমেরিকায় হালাল পণ্য রপ্তানিতে ভারত, পাকিস্তান এগিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ থাকার পরও বাংলাদেশিরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় নির্ভর করছে তৈরি পোশাক শিল্প, জনসংখ্যা রপ্তানি, হোম টেক্সটাইল, চা, ঔষধ, চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, চিংড়ি এবং জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের ওপর। বাংলাদেশের এখন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস হলো তৈরি পোশাক শিল্প এবং জনসংখ্যা রপ্তানি। এই তৈরি পোশাক শিল্প ও জনসংখ্যা রপ্তানি খাত থেকে অর্জিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। ৯০ দশকে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে সংযুক্ত হয় তৈরি পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাণিজ্য এখন কার্যত তৈরি পোশাক নির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশই আসছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। জানা যায়, জানুয়ারি-মার্চ মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ২২২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। পোশাক শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এখন শীর্ষে ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া অবস্থান করছে। বিভিন্ন তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ইতিপূর্বে এগিয়ে থাকলেও এখন বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। তবে পোষাক ব্যতীত অন্যন্য পণ্য নিয়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ বাজার নিয়স্ত্রণ করছে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য রপ্তানি বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সালে রপ্তানি আয় ছিল ৩৪৮.৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তখন বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য চা ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প। বাংলাদেশের পাটকে সোনালী আশ বলা হয়। তৎকালীন সময়ে প্রধান রপ্তানি পণ্য পাট রপ্তানি করে দেশ সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত। বিশ্ববাজারে এই সোনালী আশের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কারণে ১৯৮০ সালের পর এ শিল্পের ব্যাপক ধস নামে। ফলে বাংলাদেশ বাজার হারিয়ে ফেললে রপ্তানি আয় ব্যাপকভাবে হৃাস পায়। বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষিখাতের অবদান এখন নেই বললে চলে। বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর অধিদপ্তর ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে বটে, কিন্তু তাদের সুপ্ত প্রতিভা কখনো বিকাশিত হতে দেখা যায়না। জানা যায়, দ্রæত পচনশীল কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশে কোল্ড চেইন অবকাঠামো এখনো অপর্যাপ্ত। বিমান ও সমুদ্র বন্দরে কোল্ড স্টোরেজ, বিশেষ কার্গো সুবিধা, সময়মতো শিপমেন্ট ব্যবস্থা নেই। যার কারণে সরকার কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ব্যর্থ হচ্ছে। সাগর, নদী, খাল, বিল পরিবেষ্ঠিত বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে নাকি বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয়। জানা যায়, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১.৩৯ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় পদেেক্ষপের অভাবে মাছ রপ্তানিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। রপ্তানি বাজারে দেশীয় গরু, মহিষের হালাল মাংসের কদর রয়েছে। দেশের চাহিদার চেয়ে নাকি দেশে মাংস উদ্বৃত্ত থাকে। তারপরও বাংলাদেশ মাংস রপ্তানি করতে পারছে না। কারণ সরকারি রপ্তানির পর্যায়ে জিটুজি চুক্তি না থাকা, ওআইই সনদ না থাকা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দামের প্রতিযোগিতা। অথচ ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাংস রপ্তানি করছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, দপ্তর বা অধিদপ্তর থাকলেও তাদের তন্দ্রা কখনও ভাঙ্গে না। বাংলাদেশে রেকর্ড উৎপাদন সত্তে¡ও চা আমদানি করতে হয়। বাল্যকাল হতে একটি ¯েøাগানই শুনি আসছি, ‘বাংলাদেশ হবে স্বনির্ভর, দেশের অর্থনীতি হবে রপ্তানিমুখী’। কিন্ত্ স্বাধীনতার ৫৪ বছরও আমরা স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারিনি। আসলে কাগজে কলমে দেশ সবকিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হলেও বাস্তব ভিন্ন। আমরা এমন আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছি যে আমাদের কাঁচামরিচও বিদেশ থেকে আমদানি করে কিনে খেতে হয়।
বাংলাদেশ একটি আমদানি নির্ভর দেশ। তাই রপ্তানির চেয়ে অধিক পরিমাণে আমদানি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি ঘটছে। বাংলাদেশ শিল্পের কাচামাল, খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি তেল, খাদ্যশস্য, ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করে। রপ্তানি খাত থেকে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার অধিকাংশ কাচামাল সহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়। ফলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ যদি তৈরি পোশাক শিল্প সহ রপ্তানিকৃত অন্যান্য পণ্যের কাচামাল সহ অন্যান্য উপকরণ দেশে যোগান দেয়া সম্ভব হতো, তাহলে অর্থনীতিতে রপ্তানি খাত আরো বেশি অবদান রাখতে পারতো। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনাময়, কিন্তু সে সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মূল্য কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা। বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্যের সমস্যা সমূহ-রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের অভাব, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের নিম্নমান, রপ্তানিকারকদের অসাধু মনোভাব, কারচুপি, বৈদেশিক বাজার সন্বন্ধে অজ্ঞতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে পণ্য রপ্তানি খাত। বাংলাদেশের মতো বিকাশমান একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব অধিক। তাই সরকারকে রপ্তানির পণ্যের বাজার সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : কলামিস্ট, গবেষক