যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিন

1

সোমাবার মধ্যরাত দেশব্যাপী একযুগে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে রেলের রানিং স্টাফরা। সূত্র জানায়, রেলওয়ের রানিং স্টাফরা তাদের বেশকিছু দাবি নিয়ে মাঠে আন্দোলন চালিয়ে আসছে কয়েকদিন ধরে। নানাভাবে তারা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের দাবি পূরণের চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে একেবারে নির্লিপ্তই বলা যায়। ফলে তারা বাধ্য হয়ে দেশব্যাপী কর্মবিরতির ডাক দেয়। মূলত রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণেই সারাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে ট্রেন চলাচল। মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স (ভাতা) যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিক সুবিধার দাবি নিয়ে রানিং স্টাফদের এ আন্দোলন। দৈনিক পূর্বদেশসহ স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্দোলনকারী রেলের রানিং কর্মীরা দেশব্যাপী কর্মবিরতিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে গেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে, রাত ১২টার আগ পর্যন্ত কোনো মিমাংসা না হওয়ায় স্টাফদের এ কর্মবিরতি নিয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি রেলওয়ে। ফলে, বহু যাত্রীই অবগত হতে পারেননি ট্রেন চলাচল বন্ধের ব্যাপারে। এতে সাতসকালে স্টেশনে গিয়ে ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়েন হাজার হাজার যাত্রী।
গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামের বটতলী স্টেশনে সকালে গিয়ে দেখা গেছে, হঠাৎ রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রীরা স্টেশনে এসে ভিড় করেন, কিন্তু ট্রেন কখন নাগাদ ছাড়বে-এর সদুত্তোর কেউ দিতে পারেন নি। টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়াগুলো সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের রেলস্টেশনগুলোতে দেখা মিলেছে অপেক্ষমান যাত্রীদের ভোগান্তির চিত্র। অনেকে ফিরে গেলেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা গেছে প্রায় সবাইকে। হট্টগোলও বেঁধেছে কিছু স্টেশনে। এমনকি ক্ষুব্ধ হয়ে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটিয়েছেন কোনো কোনো স্টেশনের যাত্রীরা। রাজশাহী রেলস্টেশনে ভাঙচুরের ঘটনার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে।
রেলস্টেশনে সরেজমিনে গিয়ে বেশ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই স্টেশনে অপেক্ষা করছেন তাদের অনেকে। স্টেশনে আসা কেউই জানতেন না ট্রেন চলাচল বন্ধ। তাই কাউন্টারে এসেই পড়তে হয় বিপাকে। শীতের মধ্যে পরিবার নিয়ে আসা যাত্রীদের ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে যোগাযোগ করা হলে ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি এবং কোনো ট্রেন আসেনি। চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে সকাল ৬টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে চট্টলা, ৭টায় কক্সবাজারগামী স্পেশাল, সাড়ে ৭টায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস, ৭টা ৪০ মিনিটে সাগরিয়া এক্সপ্রেস ও ৭টা ৫০ মিনিটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। রানিং স্টাফদের কর্মবিরতির কারণে এসব ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি। এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, রানিং স্টাফরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এ কারণে সকাল থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন গন্তব্যে ছেড়ে যায়নি। কর্মবিরতি পালনকারীদের সঙ্গে এখনও আলাপ-আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়কারী মো. মজিবুর রহমান বলেন, আমরা রার্নিং স্টাফরা রাত ১২টা থেকে কর্মবিরতি পালন করছি। এ কারণে সারাদেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমাদের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।
উল্লেখ্য যে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে হলে আট ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময় কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়; যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনো ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা। মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে তিন বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন তারা। কয়েক দফায় অতিরিক্ত কাজ থেকে বিরত থাকাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে, বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন রেলওয়ের মহাপরিচালক, রেলসচিব, রেলমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসে আন্দোলন থেকে সরে আসেন। গত ২২ জানুয়ারি দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বটতলী পুরাতন রেলস্টেশনে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বলেন, রেলওয়ের রানিং স্টাফরা ১৬০ বছর ধরে অবসরের পর মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক পেয়ে আসছেল। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেদের দুর্নীতি ও অর্থ অপচয় ঢাকতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বেতন, পেনশন ও আনুতোষিক কমিয়ে দেয়। আমরা মনে করি, রানিং স্টাফদেও দাবি একেবারে অযৌক্তিক নয়। তবে যাত্রীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের আন্দোলন কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এতে সাধারণ মানুষ চরমভাবে দুর্ভোগে পড়েছে। অনেকে যথাসময়ে অফিস আদালতে যেতে পারেন নি, যা দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। আমরা আশা করি, আন্দোলনকারী রেল কর্মীদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতা বিচার করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন। না হয় জনদুর্ভোগ আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।