মোবাইল আসক্তি

2

জিতেন্দ্র লাল বড়ুয়া

বর্তমান সময়ে দেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেড়ে গেছে মোবাইল আসক্তি। আধুনিক যুগে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় শিশু-কিশোররা ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় ইন্টারনেটভিত্তিক গেমস ও নানা ভিডিও দেখা নিয়ে। আবার বর্তমান সময়ে মাল্টিমিডিয়া মোবাইল সেট অর্থাৎ অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে ও দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। পরিবারের অসচেতনতার কারণেই শিশু কিশোররা বখাটে হয়ে যাচ্ছে। অপরিণত বয়সে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধা না দেওয়ায় দিন দিন মোবাইল ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। লেখাপড়া থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর বাজারে, রাস্তার মোড়ে আড্ডা দেওয়া এবং গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় তৈরি হচ্ছে তাদের একাধিক গ্রুপ। বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করতেও দ্বিধা করে না উঠতি বয়সীদের একটা শ্রেণি। আধিপত্য নিয়েও পরস্পর পরস্পরের সাথে বিরোধে জড়াতে ও দেখা যাচ্ছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার দমবন্ধ পরিবেশে দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বেড়েছে। এ সময়ে শিশুরা শারীরিক কোনো কাজ বা খেলাধুলার সুযোগ একেবারেই পায়নি। তাই এতে বেড়েছে মানসিক নানা রোগ। গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মোবাইলে আসক্ত। এছাড়া দিনের অধিকাংশ সময় শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার স্ক্রিনে অথবা ট্যাবে ও সময় ব্যয় করে।
স্বাস্থ্যগত ভয়াবহ ক্ষতির দিকটিও উঠে এসেছে এই গবেষণায়। তাতে, দেখা যায় আগে যেখানে জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়ার মতো রোগব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হতো শিক্ষার্থীরা, আর এখন মাথাব্যথা, দৃষ্টিশক্তি জটিলতা, ঘুমের সমস্যা, বিষণ্ণতা ও খিটখিটে মেজাজের মতো ব্যাধি ও দেখা যাচ্ছে বেশি। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফলে ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আশানুরূপ ফলাফল এবং ভর্তিযুদ্ধে ঠিকতে না পেরে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ও দেখা যাচ্ছে। এসবের জন্য মাতা পিতা অভিভাবক কে দায়ী করা যায়। তাদের সন্তানদের নিয়মিত খোঁজ-খবর তারাইতো রাখবে, কোথায় যাচ্ছে কি করছে তাঁর সন্তান, অবশ্য ই অভিভাবকদের জানার কথা,দেখার কথা।
এক্ষেত্রে আমরা যারা অভিভাবক আছি আমাদেরকে আর ও অধিক অধিক সচেতন হতে হবে এ জায়গায়।
দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ তরুণ তাদের স্মার্টফোনের উপর এতোটাই নির্ভরশীল যে এটি আসক্তির মতো হয়ে গেছে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এক গবেষণায় সম্প্রতি এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এ আসক্তিমূলক আচরণের অর্থ তারা যদি মোবাইল ফোন সবসময়ের জন্য হাতে না পায় তাহলে তারা ‘আতঙ্কিত’ বা ‘বিচলিত’ হয়ে পড়ে। এই তরুণরা মোবাইল ফোনের পেছনে যে পরিমাণ সময় ব্যয় করে তারা সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এ ধরনের আসক্তিমূলক আচরণ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে, যেমন স্ট্রেস বা শারীরিক ও মানসিক চাপ, হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের অভাব এবং স্কুলের ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শিশু এবং তরুণদের মধ্যে স্মার্টফোনের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতার খুব বেশী প্রয়োজন রয়েছে এবং শিশুরা ফোনে কতটা সময় ব্যয় করছে অভিভাবকদের সচেতনতাই এখানে খুব বেশী জরুরি। স্মার্টফোনের প্রভাব সব সময় একমুখী হয় না। ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন মানুষের মেজাজে প্রভাব ফেলতে পারে, তেমনি মানুষের মন-মেজাজ স্মার্টফোন ব্যবহারের পরিমাণকে প্রভাবিত করতে পারে। স্মার্টফোনের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি, সেইসঙ্গে শারীরিক কর্মকান্ডের সুযোগ না পাওয়া, এ দুই মিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। এ সমস্যাটি যদি দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অবশ্যই তা আশঙ্কার একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই ভাবে প্রজন্ম অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তারবিহীন ক্ষুদ্র এই মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমরা অনেকেই অনেক কিছু জানি না। আধুনিক যুগে এই আধুনিক যন্ত্রটির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে কত ধরনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই।
অতিরিক্ত সময় ধরে মোবাইল ফোনের ব্যবহার যে কোন বয়সের মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নানান প্রভাব ফেলে। শুধুই শারীরিক সমস্যাই নয় এর ফলে হতে পারে তীব্র মানসিক সমস্য। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দিন দিন প্রযুক্তির উৎকর্ষের মাধ্যমে যে জিনিসটির সাথে আমরা সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত হয়ে পড়ছি, তা হলো মোবাইল ফোন। আমাদের দৈনন্দিন কাজের শুরুটাই হয় মোবাইলের এলার্মের মাধ্যমে এবং দিন শেষে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও মোবাইলই হয় আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর মাঝে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই আমরা মোবাইল নিয়ে কাটাই। সেটা হতে পারে ভিডিও, অডিও মিউজিক শোনা, ই-পেপার পড়া, যোগাযোগ, সময় দেখা বা গেম খেলা সহ নানামুখী কাজের প্রয়োজনেই।
অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষতির দিক নিয়ে একাধিক গবেষণা হচ্ছে। একাধিক গবেষণার ভিত্তিতে উঠে আসছে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যায় পড়ছেন ব্যবহারকারীরা। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদদের বিভিন্ন গবেষণায়ও উঠে এসেছে মোবাইল ফোনের নানা ক্ষতিকর দিকসমূহের কথা।যেমন- ১. ঘাড় ব্যথা, ২. চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ৩. কানে কম শোনা,৭. হঠাৎ রিংটোন শোনা, ৮. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ৯. চিন্তা শক্তি কমে যাওয়া, ১০.হতাশায় ভোগা। ইত্যাদি নানান জটিলতা নিয়মিত দেখা দিচ্ছে।
মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মানুষের তড়িৎ চিন্তাশক্তি কমে যায়।সৃজনশীল মেধা কমে যাওয়ার ফলে কোন কিছুর উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায়। মোবাইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা ও অনৈতিকতার আশ্রয় নেয়ার ফলে দিনদিন দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা নৈতিক অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
মোবাইলে গেইমস ও সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদির প্রতি আসক্তির ফলে শিশু-কিশোররা পানাহার ও দৈনন্দিন কাজকর্মে অমোনোযোগী হয়ে পড়ছে। মার্কিন ভাইরাসবিজ্ঞানী ড. ডেভরা ডিভাস মনে করেন, মোবাইলের তরঙ্গ রশ্মি শিশুদের স্বাস্থ্যক্ষতির কারণ হচ্ছে।
জাপানের ডকোমো ফাউন্ডেশন পাঁচটি দেশে জরিপ করে ৭০ শতাংশ শিশুর পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণ হিসেবে মোবাইল ফোনকে দায়ী করেছে। তাই নির্দিষ্ট বয়সের আগে কোনভাবেই শিশুর হাতে মোবাইল তুলে দেয়া যাবে না।
অনেক সময় শিশুর কান্না বা রাগ ভাঙ্গাতে অভিভাবকরা মোবাইলে কার্টুন বা গান চালিয়ে শিশুর হাতে দেন। যা পরবর্তীতে প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার আজকাল দেখা যাচ্ছে শিশুদের কিছু খাওয়ানোর সময় মোবাইল হাতে দিলেই সে খাবার গ্রহণ করবে। এটা আরেকটা আসক্তি।

মোবাইল ফোনের অন্যান্য ক্ষতিকর দিক :
শিশু-কিশোরদের মধ্যে পারিবারিক মূল্যবোধ বিনষ্ট ও মা-বাবার উপদেশ না মানার প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সুবিধার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন ও ফসলি জমিতে যে টাওয়ারগুলো নির্মিত হচ্ছে, সেগুলোর ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের ফলে মানব শরীরের পাশাপাশি গাছপালা, ফলফলাদি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
আজকাল আবার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অথবা একই বয়সের ছেলে-মেয়েদের একটা প্রবণতা খুব বেশী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাঁটতে চলতে সবসময় মোবাইল হাতে ব্যবহার করতে। মোবাইল স্ক্রিনে টানতেই আছে। এমন কি টানতে টানতে রাস্তা পার হচ্ছে অথবা কার ও সাথে ধাক্কা লাগতেছে। লিফট ব্যবহার করায় সময় ও উঠা-নামাতে মোবাইলের ব্যবহার বা আসক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মনে হয় না তখন এসব ব্যবহারকারীর আধো হুঁশ থাকে। এটা একপ্রকার অসুস্থতার লক্ষন। ধাক্কার পর কোন কোন সময় বলতে দেখা যায় ংড়ৎু আবার অনেকে দেখে ও না দেখার মত করে চলে যায়। এটা আসক্তিতো বটেই তবে এটা অসুস্থ প্রজন্ম’র একটা অশুভ ল²ণ।
স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ঘুমের সমস্যা হয় সবচেয়ে বেশি।আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, মোবাইল ফোন ব্রেন, মাথা বা গলার টিউমারের কারণ হতে পারে।দীর্ঘক্ষণ মোবাইলের ব্যবহার স্মৃতিশক্তি ও হার্টের উপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে ও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।দিন দিন প্রজন্ম অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। এই অসুস্থ প্রজন্ম বাঁচাতে অভিভাবকদেরকেই আগে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় একটি সুন্দর আধুনিক জীবন ও সুস্হ স্বাভাবিক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের সকলের কাম্য। তাই যদি হয় এখনই আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। মাতা পিতা অভিভাবক এগিয়ে আসলেই একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে উঠবে এই আশাবাদ আমরা করতে পারি। অন্যদিকে আমরা সকলে মোবাইল ব্যবহারে সতর্ক হই এবং মোবাইলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব। সে কামনাই হউক আমাদের সকলের। সকলের জয় মঙ্গল হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক