মৈত্রীর পথে মুক্তি

9

অপু বড়ুয়া

আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত আজ রাতের আকাশ। জ্যোৎস্না প্লাবিত ধরণী। কী শান্ত! কী সমাহিত। আজ মহান শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত এক অনন্য দিন। এই মহান দিনে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ, বুদ্ধত্বলাভ ও মহা-পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। একই ব্যক্তির জীবনে এ ধরনের তিনটি মহান ঘটনা জগতে বিরল।
২৫০০ বছর পূর্বে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নামে এক নগর ছিল। সে নগরে শাক্য বংশীয় রাজারা রাজত্ব করতেন। মহারাজ শুদ্ধোধন ছিলেন সে নগরের রাজা। সে সময় আষাঢ়ী নক্ষত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হতো। তাই রাজা প্রজা সকলেই সে উৎসব উপভোগ করার জন্য উৎফুল্ল হয়ে উঠতো। রাণী মহামায়া ও সে উৎসব উপভোগ করার জন্য সাতদিন পূর্ব হতে বিলাস ব্যাসন ত্যাগ করে মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ছিলেন। রাণী মহামায়া পরিপূর্ণ গর্ভাবস্থায় পিতৃগৃহ দেবদহ নগরে যাবার জন্য ইচ্ছা পোষণ করলেন। সহ¯্র অমাত্যবাহী স্বর্ণ শিবিকায় বসিয়ে রাণীকে নিয়ে দেবদহ নগর অভিমুখে যাত্রা করলেন। দুই নগর সীমার মধ্যভাগ লুম্বিনীকানন। শালশাখা পুষ্পে ভরা ছিল। ভ্রমর ও পক্ষীরা গুঞ্জন করছিল। তখন আচমকা সমস্ত উদ্যানটা স্বর্গের চিত্রলতা বন সদৃশ্য মনে হচ্ছিল। এই অপূর্ব দৃশ্য দর্শনে উদ্যানে বেড়ানোর জন্য রাণীর মনে বাসনা জাগলো। অমাত্যগণ রাণীকে নিয়ে শাল উদ্যানে উপস্থিত হলেন। এক সময় একটি শালশাখা স্পর্শ করার সাথে সাথে তাঁর প্রসব বেদনা শুরু হলো। সখ্যগণ চারদিকে যবনীকা দিল। লুম্বিনীকাননে প্রাকৃতিক অপরুপ শোভা সজ্জিত পরিবেশে বৈশাখী পূর্ণিমায় রাণী দন্ডায়মান অবস্থাতেই এক ফুটফুটে আলোকিত বাচ্ছা প্রসব করলেন। তাঁর নাম রাখা হলো ’বোধিসত্ত¡’।
জগতকে আলোর বন্যায় উদ্ভাসিত করে অহিংসার আলোকবর্তিকা নিয়ে বিশ্বভ্রমান্ডে আবির্ভাব হলেন ভাবী বুদ্ধ। সিদ্ধার্থ গৌতম। দিকে দিকে চৌদিকে আনন্দের বন্যা। রাণী মহামায়া অত্যন্ত পূণ্যবতী নারী ছিলেন। কুমার সিদ্ধার্থকে বুদ্ধ রূপে পাওয়ার জন্য তিনি জন্ম-জন্মান্তরে সৎ কর্মের অনুশীলন ও ব্রত পালন করেন। সিদ্ধার্থ গৌতম জন্ম গ্রহণ করার পূর্ব দিকে অবলোকন করলেন-তিনি দিব্য দৃষ্টিতে দেখলেন অনেক সহ¯্র চক্রবাল এক প্রাঙ্গনে জড়ো হয়েছেন। দেব নরগণ বিবিধ পুষ্প ও সুগন্ধি দিয়ে তাকে পূজা ও অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তারা বললেন-হে মহা পুরুষ এখানে আপনার সদৃশ্য কেউ নেই। আপনি মহান, আপনিই শ্রেষ্ঠ।
রাজ কুমার সিদ্ধার্থ শৈশব কাল থেকে চিন্তাশীল ছিলেন। নির্জনে বসে ধ্যান করতেন। কী যেন ভাবতেন। এতে তাঁর পিতা শুদ্ধোধন খুবই চিন্তিত থাকতেন। সিদ্ধার্থ ক্রমে বড়ো হতে লাগলেন। তিনি ষোল বছরের টগবগে যুবক রাজকুমার সিদ্ধার্থ। অমাত্যদের পরামর্শে রাজা শুদ্ধোধন তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এক সময় রাজকুমার সিদ্ধার্থ সারথি ছন্দককে নিয়ে রথে চড়ে পর পর চারদিন রাজ্য ভ্রমণে গেলেন। পথের মধ্যে -এক সময় বৃদ্ধ, রোগী, মৃতদেহ ও সন্যাসী তাঁর চোখে পড়লো। এই দৃশ্য গুলোই হলো চার নিমিত্ত। চার নিমিত্ত দর্শন করে তাঁর মনে নানা প্রশ্নের উদয় হলো। বৈরাগ্যভাব জাগ্রত হলো। রাজপ্রাসাদে ফিরে পুত্র রাহুলের জন্ম সংবাদ পেলেন। ভাবলেন সংসারের মায়াজালে ক্রমশ তিনি জড়িয়ে পড়ছেন। সেদিন রাতেই গৃহ ত্যাগের সংকল্পবদ্ধ হয়ে আষাঢ়ী পূর্ণিমার জোৎস্নাস্নাত রাতে যশোধরা ও নবজাতক শিশুকে নিদ্রামগ্ন রেখে বেড়িয়ে পড়লেন সত্য সন্ধানের নিমিত্তে।
উরুবিল্বের পাশেই ছিলো সেনানী গ্রাম। সিদ্ধার্থ ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য বের হলেন। দুর্বল দেহে বেশি দূর এগুতে পারলেন না। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে এক নিগ্রোধ বৃক্ষমূলে বসে পড়লেন। এক সময় সেনানী পরিবারের কণ্যা সুজাতা এসে তাঁকে পায়েসান্ন দান করলেন। সিদ্ধার্থ তৃপ্তি সহকারে আহার করলেন। আবার সেই বৃক্ষমূলে ধ্যানে বসলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন- আমার দেহ চর্ম সব শুকিয়ে যাক্ তবে বুদ্ধত্ব লাভ না করে এই আসন ত্যাগ করবো না। তিনি যখন কঠোর ধ্যানে নিমগ্ন ঠিক তখন মার তাকে বার বার আক্রমণ করলো। মারের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হলো। এক সময় মার পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল। সিদ্ধার্থের ৬ বছর দুর্লভ সাধনা সিদ্ধ হলো। তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করলেন। তিনি হলেন মহাজ্ঞানী বুদ্ধ।
বুদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে তাঁর ধর্ম প্রচারের জন্য আহবান জানালেন। বললেন- ভিক্ষুগণ তোমরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ো। বহুজনের হিত ও সুখের জন্য ধর্ম প্রচার করো। যে ধর্মে আদিতে কল্যাণ,মধ্যে কল্যাণ,অন্তে কল্যাণ। মহামানব বুদ্ধের কথা শুনে-তাঁরা নগরে প্রান্তরে বুদ্ধের অমৃতময় বাণী প্রচার শুরু করলেন। সকলের জন্য বুদ্ধের ধর্মে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হলো। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করলেন। বুদ্ধের বয়স ৮০ বছর। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত। বুদ্ধ তখন বৈশালীতে অবস্থান করছিলেন। একদিন পবিত্র ভিক্ষু সংঘকে ডেকে বললেন- হে ভিক্ষুগণ তোমরা অপ্রমাদের সাথে ভিক্ষু জীবন সম্পাদন করো। আত্ম নির্ভরশীল হও। ধর্ম পথে নিজেদের জীবন পরিচালিত করো। আমি না থাকলে চিন্তার কোন কারণ নাই। আমার দেশিত ধর্ম বিনয়ই তোমাদের পথ প্রদর্শক। এটাই ছিলো ভিক্ষু সংঘের প্রতি ভগবান তথাগত বুদ্ধের অন্তিম বাণী।
বৈশালী থেকে বুদ্ধ এবার সশিষ্য কুশীনগর যাত্রা করলেন। তাঁর সাথে ছিলেন বুদ্ধের প্রধানতম শিষ্য ভিক্ষু আনন্দ। মাঝ পথে পাবায় এসে বুদ্ধ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ অবস্থায় শিষ্যরা পাবায় থেকে বুদ্ধকে নিয়ে কুশীনগরের মল্লরাজদের শাল বনে এসে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি আনন্দকে ডেকে শয়নাসন তৈরি করতে নির্দেশ দেন। জোড়া শাল গাছের নিচে শয্যা রচিত হলো। মহামানব বুদ্ধ সেই অন্তিম শয্যায় শয়ন করলেন। আস্তে আস্তে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে গেল। তিনি মহা-পরিনির্বাণ লাভ করলেন। দিনটি ছিলো শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা মানে পবিত্র বুদ্ধ পূর্ণিমা।

লেখক : প্রকৌশলী চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ, গীতিকার ও সংগীত পরিচালক, বিটিভি চট্টগ্রাম