মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে বিদেশমুখী মনোভাব কমাতে হবে

1

মো. আসিফ ইকবাল

কথায় আছে শিক্ষায় জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু আজ শিক্ষা আমাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হযে দাঁড়িয়েছি। মানসম্মত আধুনিক শিক্ষাগ্রহণ এখন অনেক উচ্চ চ্যালেঞ্জের বিষয়। বার বার শিক্ষা ব্যবস্হা তথা পাঠ্য বইয়ের সিলেবাস বা বিভিন্ন ব্যবস্থা পরিবর্তনের ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ বিরাজ করে। আর আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা সুযোগ পেলে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চ শিক্ষায় স্কলারশীপ পেলে আর এ দেশে পড়ালেখায় করতে চায়না। এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ সন্তানরাই দেশের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা করাকে জীবনের পরম সাধনা মনে করে।এমনকি বিদেশ উচ্চশিক্ষার জন্য পড়তে যাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই আর দেশে আসার চিন্তা করেনা। এখানকার সিংহভাগ বিদেশেই চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে পরবর্তী জীবন ওখানেই কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে।যদি বিদেশে পড়ালেখা করতে যাওয়ার শিক্ষার্থীদের একটি অংশ দেশে এসে নিজের পেশাগত জীবন বেঁচে নেয়। কিন্তু এ সংখ্যাটি তুলনামুলকভাবে অত্যন্ত কম বলাই চলে।আর আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, শিল্পী অভিনয়শিল্পী, ব্যবসায়ী কিংবা সুশীল সমাজের সন্তানরাও বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমাই। যাদের বেশিরভাগ পুনরায় আর দেশে এসে পেশাগত জীবনে জড়াতে চায়না। তারা বিদেশের উচ্চ বিলাসী জীবনে নিজেকে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। ব্যতিক্রম হিসেবে অনেকে উচ্চ শিক্ষা শেষে দেশে আসলেও সে সংখ্যা খুবই সীমিত।আর বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রতিবছর আমাদের দেশের যে মেধাবী প্রজন্ম অন্যান্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাতে করে আমাদের দেশের মেধাগুলো অতিসহজে পৃথিবীর অনেক দেশে স্হান্তারিত হয়ে যাচ্ছে। যাতে করে আমরা দক্ষ জনবল,দক্ষ প্রশাসন,সুযোগ্য নেতৃত্ব কিংবা মেধাবী প্রজন্মের জ্ঞান থেকে অহরহ বঞ্চিত হচ্ছে।মেধাবী প্রজন্মকে ধরে রাখতে হলে আমাদের দেশে শিক্ষার পরিবেশ,শিক্ষার মান,পেশাগত নিশ্চয়তা, সুন্দর ও নিরাপদ জীবন ব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঠিক বিচার ব্যবস্থা, পরিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা, প্রযুক্তি ও কারিগরী শিক্ষার উন্নতিকরণসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে আরো অনেক বেশি সুদূর প্রসারী সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
সাধারণত কোন পিতা মাতায় চাযনা তাদের সন্তান তাদের থেকে দুরে চলে যাক শুধুমাত্র উচ্চ শিক্ষার জন্য। কিন্তু আজকাল সকল পিতা মাতায় বাধ্য হয়েই তাদের আদরের সন্তানকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। কেননা বর্তমানে দেশের শিক্ষা অর্জন করার জন্য সন্তানের নিরাপদ পরিবেশ, শিক্ষার মান ও সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রতিটি পিতা মাতায় অধিকতর দুশ্চিন্তা ও অনিরাপদ ভোগ করছে। তাই আদরের সন্তানকে একবুক যন্ত্রণা ও মায়ামমতাকে দুরে ঠেলে দিয়ে প্রিয় সন্তান দুর ভুবনে উন্নত দেশে তথা উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। যাতে করে অভিভাবক তাদের প্রিয় ও অতি আদরের সন্তানটির পড়ালেখা এবং উন্নত জীবন গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ পাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও বিদেশে উচ্চ শিক্ষায় অনেক সন্তানই তাদের পরম শ্রদ্ধেয় পিতামাতার আর সেরকম খবরাখবর কিংবা দায়িত্ব পালন থেকে দূরে সরে যায় প্রকৃতির নির্মম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতায়। এত নিষ্ঠুর বাস্তবতার মাঝেও প্রতিটি অভিভাবকই তাদের সন্তানকে ঠিকই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠাতে একনিষ্ঠ মনে সাধনা করতে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় উচ্চ শিক্ষার জন্য গমনকারী শিক্ষার্থীর কিছু অংশ আবার বিপদগামী জীবনে পা বাড়ায় যার কারণে তাদের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাজীবনও শেষ করা হয়ে উঠেনা। অনেকেই আবার সেই দেশেই রাজনীতিসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। সর্বোপরি আমাদের দেশের মেধাগুলোর যথাযথ মুল্যায়ন কিংবা পেশাগত ক্ষেত্রে আমরা কাজে লাগানোর ঐতিহাসিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।দেখা যায় আমাদের দেশের একজন শিক্ষার্থীর পেছনে শিক্ষাখাতে সরকার লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। আর সরকারের সরকারের ভর্তুকির টাকাগুলো জনগণের আয়ের কর থেকেই কর্তন করা হয়।সুতরাং মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধাগুলোর যথাযথ ব্যবহার, দেশের কল্যাণে ও পেশাগত দক্ষতায় প্রয়োগ এবং কাজে লাগানোর নৈতিক অধিকার স্বদেশের মানুষের রয়েছে। আমরা আশা করব মেধাবী প্রজন্মকে বিদেশমুখী প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে গিয়ে দেশের কল্যাণে শিক্ষাজীবন শেষে তারাও দেশে এসে দেশের উন্নয়নে নিজ অবস্হান থেকে কাজে লাগাবে। তবেই দেশ অনেক উন্নয়নের শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হবে।
ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় পছন্দের দেশ হলো যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে গেছেন ৬ হাজার ৫৮৬ শিক্ষার্থী, কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৭১৪, জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬, অস্ট্রেলিয়ায় ৪ হাজার ৯৮৭, জাপানে ২ হাজার ৮০২, ভারতে ২ হাজার ৬০ জন। অন্যদিকে ইউজিসির মতে ২০২০ সালে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৩১৭ জন, ২০২১ সালে ২.২৮১ জন এবং ২০২২ সালে ১৯৫৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছিল।
২০২৩ সালে এসবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বেশি অধ্যয়ন করে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ৬৭ জন, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি) ৫৭ জন, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে ৫৪ জন ও আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত আছে। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬৫ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৯ জন, বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ জন ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ১৬ জন বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যায়নরত। নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান, চীন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, গ্যাম্বিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, মৌরিতানিয়া, তানজানিয়া, অস্ট্রিয়া, রুয়ান্ডা, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, জিবুতি, সোমালিয়া, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, সুদান, বাহারাইন, রাশিয়া, আলজেরিয়া, বসনিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, চাদ, সেনেগাল, লাইবেরিয়া থেকে আসা মোট ৮০৫২ জন শিক্ষার্থী দেশে অধ্যায়নরত আছেন। সূত্র জানায়, উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, মরক্কো, অস্ট্রিয়া, চীন, রাশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে আবেদন করা শিক্ষার্থীদের ভিসা প্রক্রিয়া গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হলেও মধ্যম ও দরিদ্র দেশগুলোর ভিসা প্রক্রিয়া কঠিন আকারে দেখা হয়। উচ্চ শিক্ষায় যেসকল শিক্ষার্থী তাদের যোগ্যতা ও মেধায় সেখানকার প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ কর্মের যথাযথ স্হান করে নিচ্ছেন তা একদিকে আমাদের জন্য যেমন গৌরবের অন্যদিকে আমাদের মেধাশূণ্য হওয়ার অন্যতম উপদানের মতই কাজ করছে। কেননা আমাদের নিজের সন্তানদেরকে আমরা যেমন সঠিক মূল্যায়নে দেশের কাজে লাগাতে পারছিনা অনুরুপ সেই সব জায়গায় আমাদেরকে অধিক অর্থ বিনিয়োগ করে বিদেশ থেকে দক্ষ লোক এনে আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হচ্ছে। যাতে করে আমাদেরকে নানামুখী আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা তাদের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। আমাদের সন্তানদের মেধাগুলো কাজে লাগিয়ে অধিকতর দক্ষ করে দেশের কল্যাণে তাদের শিক্ষাগুলো আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সেজন্য শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ, প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা, সাংস্কৃতিক কর্মকাÐসহ সার্বিক নিরাপত্তাসহ আধুনিক প্রযুক্তিগত সেবাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক