মো. শাফায়েত হোসেন, বান্দরবান
বান্দরবানে যেন মুগ্ধতার শেষ নেই। দিগন্তজোড়া সবুজ পাহাড়ের মাঝে একদিকে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আঁকা-বাঁকা পথ আর ১১টি নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, অন্যদিকে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘের মিতালী যে কাউকেই মুগ্ধ করে, আকৃষ্ট করে। প্রকৃতির এই রূপ দেখে বুঝা যায় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কতটুকু সুন্দর। তাই মেঘ-পাহাড়ের মিতালী দেখতে ভ্রমণ পিঁপাসুদের উপচে পড়া ভিড় বান্দরবান জেলাজুড়ে। ১০ দিনের টানা ছুটিতে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বান্দরবানে ছুটে আসছেন হাজার হাজার পর্যটক।
বর্ষায় মেঘের মিতালী নিজ চোখে উপলব্ধি করেন পর্যটকেরা। হালকা বৃষ্টিতে বিমুগ্ধ পরিবেশ তৈরি হয় বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে। মনে হয় যেন মেঘের রাজ্য বান্দরবান। হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে এই মেঘ। সবুজ পাহাড়ে সাদা মেঘের এই রূপ পর্যটকদের মুগ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে জেলার মেঘলা, নীলাচল, শৈলপ্রপাত, নীলগিরি, প্রান্তিক লেক, রোয়াংছড়ির দেবতাখুম, রুমার বগালেক, থানছির তমাতুঙ্গি-নাফা খুমে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। তবে উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়, জলপ্রপাত আর ঝর্ণার মিলনে ভ্রমণ পিঁপাসুদের জন্য যেন এক স্বর্গরাজ্য বান্দরবান পার্বত্যজেরা। তাদের মনের সব খোরাক যেন এই জেলাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
পাহাড়কন্যা খ্যাত এই জেলায় রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করে প্রতিটি মূহুর্তে। পর্যটকদের কাছে অন্যতম লোভনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি নীলাচল, মেঘলা, নীলগিরি, প্রান্তিক লেকসহ বেশ কিছু পর্যটন স্পট। প্রান্তিক লেক বিনোদনের জন্য রয়েছে ট্রি-টপ অ্যাডভেঞ্চার ও জিপ-লাইন ট্রলি। এছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক জলাশয় বা পাহাড়ি লেক এবং বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালিতে ভরপুর লেকের চারপাশ। লেকটিতে উন্মুক্ত মাটির মঞ্চ, পিকনিক স্পট, বিশ্রামাগার এবং একটি উঁচু গোল ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্রেগুলোতে বিনোদনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। ঈদের টানা ছুটিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাজার হাজার পর্যটকে এখন মূখরিত বান্দরবান। যেদিকেই চোখ যায় যেন পর্যটকের ঢলই চোখে পড়ে।
চট্টগ্রাম থেকে ভ্রমণে আসা আলী সাহা ও জুই আক্তার বলেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বান্দরবানের সৌন্দর্য দেখলেও এবারই প্রথম এসেছি। সবুজ পাহাড়ে সাদা মেঘের এই রূপ আমাদেরকে মুগ্ধ করছে। বান্দরবান ভ্রমন না আসলে ঈদ যাত্রাটা অপূর্ণ থাকতো। তাই পাহাড় ঘুরে আনন্দ পেলাম।
ঢাকা থেকে সোহাগ ও নোয়াখালী থেকে ভ্রমণে আসা আমির হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সত্যিই অসাধারণ জুটি পাহাড়! আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে বান্দরবানকে। এই সৌন্দর্যটা দেখার জন্য এবং পাহাড়ে ভ্রমণ আলাদা মজা। এখানকার সবুজ পাহাড়ে মেঘ আর প্রকৃতি- সব কিছুই অসাধারণ। তবে প্রশাসন যদি এখানকার পর্যটন স্পটগুলো সম্পর্কে পর্যটকদের ধারণা দিতে নির্দেশিকা স্থাপন করতো তাহলে পর্যটকদের জন্য আরো সুবিধা হতো। সরকার একটু নজর দিলে আরও সুন্দর হতো। পলে প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটক আসবে বান্দরবানে এবং সরকারের পর্যটন খাত থেকে প্রচুর রাজস্ব আয় হবে।
রাউজান থেকে আসা পর্যটক নাতাশা বলেন, বান্দরবানের প্রান্তিক লেক ট্রি-টপ অ্যাডভেঞ্চার ও জিপ-লাইন ট্রলি ভ্রমণ করে আনন্দ পেয়েছি। পর্যটকদের ভ্রমণ আনন্দদায়ক করতে নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে প্রান্তিক এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার আরও জোরদার থাকা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ঈদের একদিন আগে ৬ জুন জেলার রুমা ও থানচি উপজেলা ভ্রমণে স্বল্প পরিসরে কিছু পর্যটন স্পট ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে প্রশাসন। নানান কারণে কয়েকটি উপজেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
বান্দরবান হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন বলেন, ঈদের টানা ছুটির কারণে পর্যটকদের ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। এতে করে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও লাভবান হয়েছে। তবে রুমা ও থানছি উপজেলা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় ঈদের ছুটিতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয়েছে সেখানে। ফলে সেখানকার উদ্যোক্তারা বড় ধরণের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
বান্দরবান ট্যুরিস্ট পুলিশ জোনের পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ হাসান ইকবাল চৌধুরী বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশের সদস্যরাও নিয়মিত নিরাপত্তার জন্য কাজ করছেন। বেড়াতে আসা পর্যটকরা যাতে নিরাপদে-নির্বিঘেœ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে বেড়াতে পারেন সেজন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও সড়কে অতিরিক্ত পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সার্বক্ষণিক মোতায়েন রাখা হয়েছে। নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই। জেলার বিভিন্ন পর্যটনস্পটগুলোতে মোবাইল নাম্বার দেয়া হয়েছে। ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছ থেকে কোনো পরিবহন কোনো অতিরিক্ত ভাড়া নিলেও আমরা ব্যবস্থা নিবো।
বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এস এম মনজুরুল হক বলেন, জেলার রুমা ও থানচিসহ সব পর্যটনস্পট উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পর্যটকরা যাতে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন সে লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও ট্যুরিস্ট পুলিশ রয়েছে, তারা সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে। আর এখানে এসে কোনো পর্যটক যাতে কোনো ধরনে হয়রানির শিকার না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে মেঘলা, নীলাচল ও প্রান্তিক লেকসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ভ্রমণ পিঁপাসুদের সুবিধার্থে প্রান্তিক লেকে অ্যাডভেঞ্চার ট্রি-টপ, জিপ-লাইন ট্রলি (জিপলাইনার) এবং শিশুদের জন্য কিডস কর্নার করা হয়েছে। এছাড়াও শিল্পের বিকাশে নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।