রতন কুমার তুরী
ঝাঁকেঝাঁকে যুদ্ধ বিমান প্রতিনিয়ত বোমা ঢালছে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখন্ডে। আর এ বোমার আঘাত প্রতিদিন মারা যাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনি। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ছোটছোট ফিলিস্তিনি শিশুর শরীর। বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে- এসব শিশুরা আল্লাহ আল্লাহ বলে চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। এমন বর্বরতা এবং করুন অমানবিক দৃশ্য নিকট অতীতে পৃথিবীরবাসী আর দেখেনি। শুধু মানুষ হত্যা নয়, ফিলিস্তিনিদের বাড়ি ঘরও ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে।
লাখলাখ ফিলিস্তিনি গাজাবাসী এখন গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশে দিন যাপন করছে। ছোটছোট শিশুদের আত্ম চিৎকারে ফিলিস্তিনির আকাশ ভারী হয়ে হয়ে ওঠছে। গাজা শহরের প্রায় ৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় রয়েছে চারটি শহর, আটটি ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবির ও এগারোটি গ্রাম। প্রায় ১২ লাখ ফিলিস্তিনী ও ১৭ হাজার নতুন ইসরায়েলী বসতিস্থাপনকারী এতে বসবাস করে। গাজা ভূখন্ডের পশ্চিমে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে মিশর এবং উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে ইসরায়েল। এ ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখÐকে বারবার রক্তে রঞ্জিত করেছে।
ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার প্রশ্নে ইসরায়েল একবিন্দুও ছাড় দেয়নি। প্রতিদিন ইসরায়েলীরা পাখির মত ফিলিস্তিনিদের মেরেছে। বর্তমানে ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকাটিকে ইসরায়েলীরা ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করেছে। হামাস নেতা খোঁজার নামে ইসরায়েলীরা বর্তমানে গাজায় নারকীয় বর্বতা চালাচ্ছে। হামাস প্রশ্নে ইসরায়েলীরা বর্তমানে গাজায় তাদের নৃশংসতা এতো পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে যে, বিশ্ববিবেক তা দেখে চমকে ওঠছে। কত কয়েকদিন আগে গাজায় যুদ্ধ বিরতি ভেঙে ইসরাইলীরা বর্বর হামলা চালিয়ে শ’য়ে শ’য়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষ থেকে এলাকা ছাড়তে বলায় গাজাবাসী বাড়ি ছাড়তে শুরু করেছেন। এর আগে গাজা উপত্যকার বেইত হানুন এলাকায় এক দিনে নিহত ৭০ ফিলিস্তিনিনিহত হয়েছে। অন্যদিকে গাজা নগরীতপ ‘সর্বশেষ সতর্কতা’ জারি ইসরায়েল। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত বৃহস্পতিবারও জোরালো হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। চালানো হচ্ছে স্থল অভিযান। এর আগে এক বিবৃতিতে গাজা থেকে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা ও হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের প্রতি ‘সর্বশেষ সতর্কতা’ জারি করেছে ইসরায়েল।
আল-জাজিরা বলছে, গাজাজুড়ে গতকাল বুধবার এক দিনে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৭০ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় আবারও হামলা জোরদার করে ইসরায়েলি বাহিনী। এর পর থেকে সেখানে নিহত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৪৩৬- এ। এর মধ্যে ১৮৩টি শিশু। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য এটা। ইতিমধ্যে গাজায় স্থল অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। বলা হয়, নিরাপত্তাব্যবস্থা বিস্তৃত করা এবং গাজার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে আংশিক বাফার জোন প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় স্থল অভিযান আবারও শুরু করা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখতে বিদেশি সরকারগুলোর আহ্বান অমান্য করে আকাশ ও স্থলপথে হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল। এর ফলে গাজাবাসী আবারও ধ্বংসস্তূপে প্রিয়জনের মরদেহ খোঁজার মতো করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে গত জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি ভেস্তে গেছে। ‘মা, আমি ক্লান্ত, মরে যেতে চাই’: ইসরায়েলি আগ্রাসনে এভাবে মানসিক বিপর্যয়ে ফিলিস্তিনি শিশুরা।
গাজা নগরীতে কংক্রিটের স্তূপ থেকে এক শিশুর মরদেহ সরানোর চেষ্টা করছিলেন এক ব্যক্তি।
তিনি বলেন, ‘আমরা খালি হাতেই ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছি।’ ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে চিহ্নিত এলাকাগুলো ছেড়ে যেতে বেসামরিক গাজাবাসীকে নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। এরপর স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের শিশুদের নিয়ে গাজার উত্তরাঞ্চলের সড়কগুলোয় ভিড় জমান। রাফায় রেডক্রসের হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা কর্মকর্তা ফ্রেড ওলা বলেন, গাজায় নতুন করে হামলা শুরুর ঘটনা গত দুই মাসের আপেক্ষিক শান্তিকে ভেস্তে দিয়েছে। তিনি যোগ করেন, ‘এখন আমরা বাতাসে আতঙ্ক অনুভব করছি। আমরা যাঁদের সেবা দিচ্ছি, তাঁদের চোখেমুখে ব্যাথা আর ধ্বংসের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।’ গাজার বাসিন্দাদের উদ্দেশে দেওয়া সতর্কতামূলক ভিডিওতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কার্তজ বলেন, ‘এটাই সর্বশেষ সতর্কবার্তা।’
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরামর্শ মেনে নিন। জিম্মিদের ফিরিয়ে দিন। আর হামাসকে সরিয়ে (ক্ষমতা থেকে) সরিয়ে দিন। যাঁরা গাজা ছেড়ে স্বেচ্ছায় বিশ্বের অন্যত্র চলে যেতে চান, সেটাসহ আরও অনেক বিকল্প আপনাদের জন্য উন্মুক্ত হবে।’ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখন্ডে হামলা চালায় হামাস। জিম্মি করা হয় ২৫১ জনকে। ৫৮ জন এখনো গাজায় জিম্মি আছেন। আর ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে, জিম্মি অবস্থায় ৩৪ জন মারা গেছেন। গাজায় হামলা চালিয়ে চার শতাধিক মানুষ হত্যার পর নেতানিয়াহু বললেন, ‘এটা কেবল শুরু’।
এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর গত সোমবার দুপুর নাগাদ নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ছিল ৪৮ হাজার ৫৭৭। গতকাল দুপুর নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৫৪৭। সে হিসাবে গাজায় দুই দিনে ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন প্রায় এক হাজার বাসিন্দা। গতকাল দুপুর পর্যন্ত ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান ও ড্রোন হামলায় ৯৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে এএফপির আজকের প্রতিবেদনে নিহত মানুষের সংখ্যা ৪০০- এর বেশি বলে জানানো হয়। ইসরায়েলের একগুয়ে প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর কারণেই মূলতঃ ফিলিস্তিনিতে শান্তি আসছেনা।
এ একগুয়ে প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে ইতিমধ্যেই মানবতার সকল স্তর অতিক্রম করেছে। শিশু হত্যা, হাসপাতালে বোমা, শরনার্থী শিবিরে বোমা, দালানের পর দালান ধ্বংস করে দেয়া কিছুই বাদ রাখেনি। এখন গাজা মুলতঃ ধ্বংসস্তুপের নগরীতে পরিণত হয়েছে। আমরা গাজায় মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধের অবসান চাই। আমরা ফিলিস্তিনিতে আর কোনো শিশুহত্যা চাইনা। বিশ্বনেতাদের গাজায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য একসাথে কাজ করতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করবো ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল খুব দ্রুতই তাদের নির্মম আগ্রাসন বন্ধ করবে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক