মৃত্যুকে ভুলতে পারি, মৃত্যু আমাদের ভুলে না

0

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

দুনিয়ার মধ্যে কতশত মৃত্যু ভেঙে দিল কত সংসার। কত জনকে করে দিল এতিম তার নেই ইয়ত্তা। আমরা ক্ষণস্থায়ী জীবনকে মনে রাখি বারবার। চিরস্থায়ী অনন্তকালের কথা মনে রাখি না। মৃত্যু আপনি ভুলে যেতে পারেন কিন্তু মৃত্যু আপনাকে কখনো ভুলবে না, শত শত মৃত্যু দেখার পরও আমরা মৃত্যু মনে রাখতে পারি না। মরণ দেখেনি দুনিয়ায় একজন। তিনি হলেন হযরত আদম (আ.)। দুনিয়ায় তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনি কত দিন বাঁচবেন। তাঁর এক হাজার বছর হায়াত হতে হযরত দাউদ (আ.)কে ৬০ বছর দান করেছিলেন। মৃত্যুকালে তা হযরত আদম (আ.) ভুলে যান। তাই আদম (আ.)’র সন্তান হিসেবে আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই। এমন কী মৃত্যুকেও ভুলে যাই। আদম (আ.)’র চরিত্র মানব জাতির নিকট অনন্তকাল রয়ে যাবে। হযরত আদম (আ.)’র মাতা পিতা ছিল না, তাই মাতা-পিতার ভালোবাসার সুযোগ ছিল না। ভালোবাসা উপরের দিকে গড়াতে পারেনি। তাঁর সন্তান হিসেবে আমাদের ভালোবাসার উপরের দিকে কম গড়ান। আমরা আমাদের পিতা মাতা হতে সন্তানকে বেশী ভালোবাসি। হযরত আদম (আ.)’র বাম পাঁজরের হাড় দ্বারা হওয়া (আ.) সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদের বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে আমাদের স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন বিধায় আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের আপনজন হতে আজান অচেনা একটি মেয়ে যখন স্ত্রী হয়ে আসে তাকে আমরা পুরনো জন হতে বেশি ভালোবাসি। এসব সৃষ্টির শুরুর আদম (আ.)’র চরিত্র তার সন্তানদের মধ্যে জারি রয়েছে।
মানব জীবনে বড় ট্রাজেডী হলো, যে সন্তানদের জন্য আপনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা দুনিয়াতে আপনজন ছিল তারা সবাই মিলে নিজ কাঁধে বহন করে অন্ধকার কবরে রেখে আসবে, কেউ তোমার সাথে থাকবে না, যাবে না, সে দিন শুধু সাথী হবে আমাদের আমল। অথচ আমল করতে আমাদের গাফেলতি দেখা যায়, অন্য বহু কাজ আমরা নিখুঁত ভাবে করি। কিন্তু আমল করি না।
এক শ্রেণীর চার্বাক দর্শনবাদীর মত মানুষ আছে, যারা বিশ্বাস করে জানে হ্যায় তো জাঁহান হ্যায়’। অর্থাৎ জানে আছে, তো জাঁহান আছে। আমরা মৃত্যুর পর পুরো দুনিয়াটা যদি স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দিলে, সাগরের সব পানি শরবত হলে আমার কী ? আমি তো খেতে পারবো না। তারা বলেন, বেল পাকলে কাকের কী ? কী হবে আমার সৃষ্টিশীল কাজ দিয়ে। আমার প্রতিষ্ঠান দ্বারা আমার কী হবে লাভ ? তারা আবার কোন কোন ক্ষেত্রে স্ববিরোধী চরিত্র প্রকাশ করে। এসব মানুষ তাদের সন্তানদের যতœসহকারে শিক্ষাদেয়। ভালোবাসে, লালন পালন করে, সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে মরণপণ লড়াই করে। সন্তান হারালে বেদনা বিধুর হন। তাঁরাও প্রকৃত পক্ষে বেঁচে থাকতে চায় তাদের সন্তানদের মধ্যে দিয়ে। মৃত্যুর পর স্বার্থপর মানুষও বেঁচে থাকতে চায়।
মানুষের জীবন বড় একটি চাওয়া তাঁর মৃত্যুর সংবাদ। মৃত্যুর সংবাদটা সংবাদ মাধ্যমে কী ভাবে প্রকাশ হলো তা সকলে দেখতে চায় না। সফলতার সংবাদ প্রচার হোক তা মৃত্য ব্যক্তির স্বজনেররও প্রার্থনা করেন। যদিও দুনিয়ায় ভালো মানুষের মূল্য কম। আমরা ভালো সৎ মানুষকে রেসপেক্ট করি, এক্সাপস্ট করি না, স্মরণ করি, অনুসরণ করি না। যাদের অনুসরণ ও গ্রহণ করি না তাদের সম্মানে কোন উপকার নেই।
জাপান, ইউরোপ, আমেরিকায় শোক সভা-স্মরণ সভা নেই, কিন্তু ভালো মানুষের অনুসরণ আছে। আমাদের হৃদয়ের টানে শোক সভা আছে, স্মরণ সভা আছে কিন্তু অনুসরণ কম লোকই করে। জাপানসহ বহু উন্নত রাষ্ট্রে শোকের কান্না করতে মানুষ ভাড়া করে আনা হয়। জাপানে দেখছে পিতা-মাতার সমাধিতে মন্ত্র পড়ছে রোবট নিযুক্ত করেছে, সন্তানের মন্ত্র পড়ার সময় নেই। কারণ মৃত ব্যক্তির জন্য শোক সভা, স্মরণ সভা করুন, কবরে দোয়া পাঠ তাতে পুণ্য আছে কিন্তু মানুষের হৃদয় জয় করা, ভালোবাসা অর্জনই মহৎ কাজ।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.) বলেছেন, যখন আমি তোমাদের হতে বিদায় নিবো তখন তোমরা আমাকে আমার সমাধিতে না খুঁজে মানুষের হৃদয়ে আমাকে খুঁজে নিও’। প্রকৃত মানুষ, মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করে। মানুষের হৃদয় জয় সবাই করতে পারে না এটি একটি কাজ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘রাজ্য জয় করা সহজ, মানুষের হৃদয় জয় করা কঠিন’।
বিশেষ করে বাঙালি জাতি নেতিবাচক হন। মানুষের গুণের দিকে তাকায় না। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের হৃদয় জয় করা খুবই কঠিন। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, তোমরা একে অন্যের দোষ অন্বেষণ করো না। কারো পশ্চাতে নিন্দা করো না। এমন কী কেউ আছো যে নিজের ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করো ? তোমরা তো ঘৃণাই মনে করো। (সূরা হু জারাত, আয়াত : ১২)
মহান আল্লাহ পাকের ঘোষণা অনুযায়ী জীবিত মানুষের দোষ খোঁজা ও নিন্দা করাকে মৃত্য ভাইয়ের গোস্ত খাওয়ার সমতুল্য। যেসব জন্তুর গোস্ত হালাল, সেসব জন্তুর মৃত হলে তার মাংস হারাম। আবার মানুষের গোস্ত খাওয়া হারাম। এখানে দুই হারামের সমতুল হলো জীবিত মানুষের দোষ খোঁজা। যেখানে জীবিত মানুষের দোষ খোঁজা বা নিন্দা করাকে ডাবল হারাম করা হয়েছে সেখানে মৃত ব্যক্তি দোষ ও নিন্দা করা তো বড় কঠিন পাপ। তাই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, উজকুরু মহাসিনা মাওতাকু অর্থাৎ তোমরা মৃত ব্যক্তির সৎগুণগুলো স্মরণ করো। এটি নবীজীর নির্দেশ। তাঁর নির্দেশ মানে ইবাদত। যদিও আল্লাহ জমিনে ধার্মিকে চেয়ে অর্ধামিক বেশি, জ্ঞানীর চেয়ে অজ্ঞানী বেশি, পন্ডিতের চেয়ে মূর্খ বেশি, ধনীর চেয়ে গরীব বেশি, দাতার চেয়ে কৃপণ বেশি, ভালোর চেয়ে খারাপ বেশি, খারাপের প্রতি আকর্ষণ বেশি, সৎ মানুষের চেয়ে দুর্নীতিবাজ বেশি, তারপরও মানুষের মন্দ দিকটা চর্চা করা মানুষকে নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলে। তাই প্রয় নবী (দ.) মানুষ গুণগুলো তুলে ধরতে বলেছেন।
মানুষ পাপ করে মহান আল্লাহ পাক তার বান্দাকে অনেক ভাবে মাপ করে। প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘মহান আল্লাহপাক তাঁর রহমত ও দয়ার ৯৯ ভাগ নিজের নিকট রেখেছেন, এক ভাগ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিতরণ করেছেন,’। অন্য এক হাদিসে বর্ণনা আছে, ‘মা-বাবা একটা সন্তানকে কতটুকু ভালোবাসেন তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি ভালোবাসেন আল্লাহ তার বান্দাকে। মহান আল্লাহ পাক তাঁর রহমত ও দয়ার সাগর দ্বারা তাঁর বান্দাকে বহু ভাবে ক্ষমা করবেন।
মহানবী (দ.)’র বিখ্যাত সাহবী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁর সন্তানের নামাজে জানাজায় উপস্থিত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তাঁর নিকট প্রশ্ন করা হলো, কার জন্য অপেক্ষা করে আছেন ! তিনি জানালেন, আমার নবী ঘোষণা করে গেছেন, চল্লিশ জন মানুষের মধ্যে একজন আল্লাহর কামিল বান্দা আছে। এখনো পর্যন্ত ৪০ জন পূর্ণ হতে একজন বাকী আছে। আমি ৪০ জন পূর্ণ হতে অপেক্ষা করে আছি। যে কামিল বান্দার উসিলায় আমার ছেলের জানাজাটা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। গুনাহ মাফ হবে। কামিল বান্দার উসিলায় বহু মানুষের মুক্তি হয়।
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.) ইরশাদ করেছেন, ৪০ জন বা ১০০ জন মুসলমান জানাজার নামাজে উপস্থিত হয়ে মৃত্যু ব্যক্তির জন্য দোয়া করলে মৃত্যু ব্যক্তি ক্ষমার যোগ্য হয়ে যান।
কামিল ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের মত নয়। তাঁদের দোয়া আল্লাহপাক কবুল করে। সাধারণ মানুষ মারাগেলে একটি নফসের মৃত্যু হয়। আর কামিল আলেম মারা গেলে একটি জাহানের মৃত্যু হয়। প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘মাউতুল আলেমে কা মাউতুল আলম’। একজন আলেমের মৃত্যু একটি জাহানের মৃত্যুর সমান। মাওলানা জালালা উদ্দিন রুমী (র.) বলেছেন, মৃত্যু মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। আবার কোন কোন ব্যক্তি মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রন করে। তাঁরা হলো আল্লাহর অলি। তাঁরা শারীরিক ভাবে মৃত্যুবরণ করলেও মৃত্যুর পর তাদের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধিপায়। প্রকৃত কামিল ব্যক্তির দোয়ায় মানুষের মুক্তি আসে।
মহান আল্লাহ পাক মানুষকে করেছেন, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। সৃষ্টির সেরা হিসেবে। এই মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন জান্নাত। এই জান্নাতও আল্লাহর সৃষ্টি। তাই জান্নাতের চেয়ে মানুষ বড়। যদি আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারি। প্রকৃত মানুষ হতে না পারলে মানুষ জাহান্নামের চেয়ে অধমে পরিণত হয়। তখন মানুষ হয় জাহান্নামের জ্বালানি। মানুষ হওয়া সহজ কাজ নয়। প্রকৃত মানুষ হতে পারলে জান্নাত মানুষের গোলামী করবে। মানুষ জন্মে মিশু, নৈতিক শিক্ষায় যিশু না হয় পশু। বর্তমান যিশু নয় পশুর সংখ্যাই দিন দিন বাড়ছে। আল্লাহ আমাদের মুক্তি দান করুন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক