গতকালের রাতছিল পবিত্র শবে মেরাজ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের রহমত কামনায় আজ রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে মসজিদে কিংবা নিজ গৃহে কোরআনখানি, জিকির-আজগার এবং ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে পবিত্র শবে মেরাজ পালন করেছেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতের দশম বছর ৬২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রজব দিবাগত রাতে আল্লাহর সান্নিধ্যে মিরাজ গমন করেন। তাই রাতটি মুসলমানদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ এবং মসজিদুল আকসা থেকে সাত আসমান পেরিয়ে আরশে আজিম সফরকে ‘মেরাজ’ বলা হয়।
৬২০ খ্রিস্টাব্দ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দুই প্রিয় ব্যক্তি স্ত্রী খাদিজা (রা.) এবং চাচা আবু তালেবকে হারিয়েছেন। তাছাড়া ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তায়েফ গেলে সেখান থেকেও আশাহত হয়ে ফেরেন। এরপর মহান আল্লাহ ইসরা ও মেরাজের মাধ্যমে প্রিয় রাসুলকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন। এই রাতে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দিদার লাভ করেন এবং আল্লাহর কাছ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে দুনিয়ায় ফিরে আসেন।
মেরাজের ঘটনা নবী জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। নবীজীর রেসালাত প্রমাণের অনেক বড় এক মুজিযা। উম্মতের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় নিয়ামত। মেরাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা নবীজির সম্মান আরো বৃদ্ধি করেছেন। গোটা সৃষ্টি জগতকে তার উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করেছেন। এই ঘটনা ইসলামী আকীদা ও বিশ্বাসেরও বড় একটি অংশ। রয়েছে এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও নির্দেশনা। লুকিয়ে আছে অসংখ্য ইলাহী হিকমত ও রহস্য। নবীজির মেরাজ সত্য। এটা বিশ্বাস করা ও এর উপর ঈমান প্রত্যেক মুমিনের উপর অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন : পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান। যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর শ্রোতা এবং সব কিছুর জ্ঞাতা। (সূরা বনী ইসরাইল : ১)।
মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করেছেন। এ সময় রাসুল (সা.) কে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি দেখানো হয়। এ রাতে উম্মতের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ ঘোষণা করা হয়। তিনি মহান আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। কথা বলেন। সাত আসমান সহ পুরোটা ভ্রমণ করেন। এ ছাড়া আরো বিভিন্ন মূল্যবান জিনিস মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে লাভ করেন। অনেককে শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে সমবেত হতে দেখা যায়। বহু নারীও সেই রাতে নামাজ আদায় করার পদ্ধতি কী অনেক সময় জানতে চান। বহু মুসলমান মেরাজের রোজা রাখার বিধান জানতে চান। নামাজ আদায় করা ও রোজা রাখা অবশ্যই পুণ্যের কাজ। কিন্তু শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো নামাজ ও রোজার বিধান ইসলামি শরিয়তে নেই। কোরআন-হাদিসের কোথাও নেই। আল্লাহর রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণ এই দিনে বিশেষভাবে কোনো রোজা রেখেছেন বা রাতে বিশেষ কোনো আমল করেছেন, এমন কোনো বর্ণনা ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এই দিনে শবে মেরাজ উপলক্ষে রোজা রাখা বা রাতে বিশেষ কোনো আমল করা ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না।
সুতরাং শবে মেরাজ উপলক্ষে আলাদা বিশেষ নামাজ-রোজা আদায় করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অন্যথায় আমি গুনাহের ভাগিদার হবো। শবে মেরাজকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা শরিয়ত সমর্থন করে না। এই রাতে আলোকোজ্জ্বল করাও ঠিক নয়। এই রাতে শিরনি বিতরণ, খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ আয়োজন করা শরিয়ত সমর্থিত নয়। কিছু কিছু এলাকায় এরকম করতে দেখা যায় যা বর্জন করা অতীব জরুরী। কারণ ইসলামি শরিয়তে কেউ নিজের পক্ষ থেকে কোনো কিছু সংযোজন করলে তা অগ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যাত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন : কেউ আমাদের এই শরীয়তে নাই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৬৯৭)।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র মেরাজের ঘটনায় আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় ও করণীয় বিষয় রয়েছে। মেরাজের ঘটনা থেকে মুমিন সঠিক পথের দিশা খুঁজে পায়। আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও দ্বীনের অবিচলতা লাভ করে। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) যে আল্লাহ তাআলার কাছে কত দামি ও মর্যাদার অধিকারী, তা এ ঘটনা থেকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। তাকে এমন মর্যাদা দান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো নবীকে দান করা হয়নি। মেরাজ নবীজির নবুওয়াতের অকাট্য দলীল। নবীজির মেরাজ সত্য হওয়া সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে। এজন্য কোনো মুসলমানের পক্ষে তা অস্বীকার করা কিংবা এ ব্যাপারে সংশয় দেখানো যাবে না। এমনকি একজন খাঁটি মুসলমানের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মিরাজের সত্যতা প্রমাণের অপেক্ষা না করে এ বিষয়ে মনেপ্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানি কর্তব্য। মেরাজের প্রতি পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস স্থাপনই হলো-শবে মেরাজের করণীয়। তাই আসুন শবে মেরাজ সম্পর্কে অমূলক ও ভিত্তিহীন কার্যকলাপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখি। মহানবীর (দ) মেরাজের বর্ণনা হতে ইসলামী শরিয়তের পাপ-পুণ্যের বিধিবিধান সম্পর্কে অবগত হয়ে আল্লার নির্দেশিত আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে পারলে খাঁটি মুসলিমের জীবনযাত্রা সাফল্যমÐিত হবে । মেরাজের ঘটনা তারই প্রমাণ বহন করে।