সোহেল মো. ফখরুদ-দীন
মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য এবং তার ধারাবাহিকতা বহন করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ধর্মীয় শিক্ষা, বিশেষ করে কোরআন শরীফের পাঠ এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। একসময়, প্রতিটি মুসলমান পরিবারেই ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের জন্য মকতব বা ধর্মীয় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা ছিল, যেখানে শিশুদের কোরআন শরীফ ও ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষাগ্রহণ করা হত। এটি শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং মুসলিম সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ, যা আজও অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান আছে।
মকতব ইসলামের প্রথম শিক্ষা কেন্দ্র : মকতব হল একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা মূলত ইসলামিক শিক্ষার শুরু। মুসলিম সমাজে, মকতবকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়, কারণ এটি শিশুদের জন্য ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম স্থান। সাধারণত, মকতবগুলোতে শিশুদের কোরআন পড়া, শরীয়াহ (ইসলামী আইন), আকাইদ (বিশ্বাস), ফিকাহ (ইসলামী আইন), নৈতিকতা এবং আদবের শিক্ষা দেওয়া হয়। প্রাচীনকাল থেকে, মকতবগুলো ছিল একটি গৃহপাঠশালা বা আদি শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে ধর্মীয় হুজুর, শিক্ষকরা ছাত্রদের কোরআন শরীফ মুখস্থ / বা দেখে দেখে পড়তে শুরু করেন। এই মকতবে (কোরআনের ব্যাখ্যা) শেখাতে এবং ইসলামী জীবনবিধি সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন হুজুরগণ। মকতবের পাঠশালা ছিল মূলত ব্যক্তিগত এবং ছোট আকারের, যা সাধারণত বাড়ির পাশেই স্থাপিত হত। এটা ছিল মুসলিম শিশুদের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক নৈতিকতা, একে অপরকে সম্মান করা, সততা, এবং আদব-শিষ্টাচার শেখানো হত।
কোরআন শরীফের শিক্ষা: মুসলমানদের জীবনের মূল ভিত্তি: পবিত্র কোরআন শরীফ মুসলমানদের জীবনের প্রধান নির্দেশিকা। তাই, মুসলিম পরিবারের শিশুরা সর্বদা কোরআন শেখার জন্য উৎসাহী থাকত। মকতবের মাধ্যমেই কোরআন শেখানোর প্রচলন হয়েছিল এবং তা এখনো অনেক পরিবারে অব্যাহত রয়েছে। কোরআনের শিক্ষার মাধ্যমে একটি শিশু প্রথমবারের মতো ইসলামিক বিশ্বাস, আল্লাহর উপাসনা, প্রার্থনা (নামাজ) এবং ইসলামী আচার-আচরণ সম্পর্কে জানতেন।
কোরআন পাঠের পাশাপাশি মকতবে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলি শেখানো হত, যেমন: ১) তাওহীদ: আল্লাহর একত্ববাদের বিশ্বাস। ২) রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম): নবী-রাসূলদের প্রতি বিশ্বাস। ৩) হাদীস: নবী মহম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাণী। ৪) নামাজ: ইসলামি উপাসনার মূল স্তম্ভ। ৫) রোজা, হজ, জাকাত: ইসলামের অন্য গুরুত্বপূর্ণ রীতিনীতি।
আমাদের মুসলিম শিশুদের মকতবের মাধ্যমে কোরআন শরীফ পড়া/ হেফজখানায় মুখস্থ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তাদের ছোট বয়স থেকেই কোরআন পড়া শুরু করা হয়, এবং প্রতিদিন কিছু সময় দেওয়া হয় কোরআন শরীফ পাঠস্থ করার জন্য। ফলে, শিশুদের জীবনে কোরআনের মর্ম, বার্তা, এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলি সহজেই স্থাপিত হয় শিশুকাল থেকে।
ইসলামি শিক্ষার মৌলিক বিষয়: মকতবের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হলে , যা মুসলমান সমাজের জীবনের প্রতিটি দিক প্রভাবিত করবে। এটি শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, বরং একজন সৎ মানুষ এবং ভাল মুসলমান হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক শিখন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা মকতবে শিশুদের শেখানো হত: ১) নামাজ: ইসলামি জীবনব্যবস্থায় নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মকতব গুলোতে শিশুদের নামাজের পদ্ধতি, তার নিয়ম-কানুন, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাবসহ বিভিন্ন দিক শেখানো হতো। এই শিক্ষা তাদের জীবনে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরত। ২) আখলাক: ইসলাম শুধু ধর্মীয় আচার-আচরণ শেখায় না, বরং চরিত্র গঠনেরও উপর গুরুত্ব দেয়। শিশুরা মকতব থেকে সততা, সহানুভূতি, দানশীলতা, নম্রতা এবং অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শেখত। ৩) তাওহীদ ও রিসালাহ: মকতবগুলোতে শিশুদের ইসলামিক বিশ্বাসের মূলনীতি যেমন তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ) এবং রিসালাহ (রাসূল আল্লাহর প্রতিনিধি) শেখানো হত। ৪) ইসলামী আচার-আচরণ: ইসলামিক রীতিনীতি যেমন খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথা বলা, দানের অভ্যাস প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হত।
মকতবের গুরুত্ব: সমাজের ঐতিহ্য রক্ষায় ভূমিকা: মুসলিম সমাজে মকতবের গুরুত্ব শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মকতব শিশুদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সহনশীলতা এবং সমাজে সঠিক আচরণ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে সমাজে ধর্মীয় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। মুসলিম পরিবারে শিশুদের জন্য মকতবের উপস্থিতি এক ধরনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে কাজ করত, যেখানে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করত এবং পরবর্তীতে ঐশী জ্ঞান লাভের জন্য ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারত। এই ঐতিহ্য মুসলিম সমাজে যুগের পর যুগ চলে আসছে।
আধুনিক যুগে মকতব ও ধর্মীয় শিক্ষা: বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির বিকাশের ফলে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু মকতবের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা এখনো অমলিন। একদিকে আধুনিক স্কুল এবং কলেজে পড়াশোনার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে মকতবের গুরুত্বও শূন্য হয়ে যায়নি। বহু মুসলমান পরিবার এখনো নিজেদের সন্তানদের জন্য মকতবের ব্যবস্থা করে থাকে, যেখানে তারা কোরআন পাঠ, নামাজ, এবং ইসলামিক সংস্কৃতি শেখে। মুসলমান সমাজের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে মকতবগুলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মকতব শুধুমাত্র ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দেয় না, বরং মুসলিম শিশুকে তার ধর্মীয় দায়িত্ব ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলির জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে একটি শিশুর জীবন আলোকিত হয় এবং সে সৎ, নৈতিক এবং মুসলমান হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাই প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মকতব বা ইসলামের শিশু শিক্ষার সুচনা বিদ্যাপীাঠ চালুকরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়ের প্রয়োজনে সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে।
লেখক: সভাপতি, মুসলিম হিস্ট্রি এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম