মুহাম্মদ গোলামুর রহমান আশরফ শাহ
স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪৭। বিশ্বের কোটি মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনধারা ও ইসলামী জীবনাচারে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে হিজরি সন। মুসলমানরা হিজরি সন ও তারিখ মেনে স্বতন্ত্র জীবনধারা পরিচালিত করে আসছে। হিজরি নববর্ষ উপলক্ষে ইসলামী কৃষ্টি সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম বেশ আলোড়িত ও উদ্দীপ্ত হতে পারে। যুব তরুণদের অবক্ষয়গ্রস্ততা থেকে বের করে এনে ইসলামী মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করতে হিজরি বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য সূচনা চট্টগ্রাম থেকে। হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ এবারসহ ১৬ বছর ধরে বর্ণাঢ্য আয়োজনে হিজরি নববর্ষ উদযাপন করে আসছে। রাহমাতুল্লিল আলামিন মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মাতৃভ‚মি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার কাফের কুরাইশরা মহানবী (দ.) এবং তাঁর সাহচর্যপ্রাপ্ত সাহাবায়ে কেরামের ওপর নানামুখী নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। শত নির্যাতন বাধার মুখেও মহানবী (দ.) তের বছর ধরে মক্কায় ইসলামের প্রচার প্রসারে অনবদ্য ভ‚মিকা রাখেন। ইসলাম প্রচার করায় মহানবী (দ.)-কে হত্যার হুমকি দিতে থাকেন কুরাইশ নেতারা। মক্কার কাফের নিন্দুক বিদ্বেষীরা ইসলাম প্রচারে নানাভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালে এমনকি তাঁর জীবন হুমকির মুখে পড়লে মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (দ.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে মদিনায় হিজরত করার মনস্থির করেন। মহানবীর (দ.) এই হিজরত থেকেই ‘হিজরি’ শব্দটি এসেছে। হিজরত মানে দেশত্যাগ,বিচ্ছেদ। মক্কাবাসীর কাছ থেকে নিপীড়নের শিকার হলেও প্রিয় নবী (দ.) কে মদিনাবাসী সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করে নেন। প্রিয় নবী (দ.) মদিনায় এসে মুসলিম ইহুদি খ্রিষ্টানসহ বহু জাতি গোষ্ঠীকে নিয়ে কল্যাণমূলক মদিনা রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। দিনে দিনে এই রাষ্ট্র দিকে দিকে স¤প্রসারিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে এসে দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেন আমিরুল মুমেনিন হযরত ওমর (রা.)। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন প্রদেশে প্রশাসক নিয়োগ দেন খলিফা হযরত ওমর (রা.)। এদিকে কুফার গভর্নর হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.) শাসনকার্য পরিচালনাকালে একদিন চিঠি দিয়ে হযরত ওমর (রা.) কে জানান যে,তাঁর কাছে মদিনা রাষ্ট্র থেকে নিয়মিত দাপ্তরিক যে সমস্ত চিঠি, দিক নির্দেশনা ও নথিপত্র প্রদান করা হয় তাতে সন তারিখ উল্লেখ করা হয় না। ফলে তিনি দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নিত্য বিড়ম্বনা ও অসুবিধার সম্মুখীন হন। কুফা গভর্নরের কাছ থেকে এ অভিযোগ পেয়ে হযরত ওমর (রা.) শীর্ষস্থানীয় সাহাবাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। তাঁরা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি নতুন সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। বৈঠকে বিশিষ্ট সাহাবিরা নানা মতামত দেন। নতুন সনের নাম কী হবে, কী উপলক্ষে কখন থেকে সন গণনা করা হবে তা নিয়ে নানা মত দেন সাহাবিগণ। কেউ বলেন মহানবীর (দ.) নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে সন গণনা শুরু হোক। আবার কেউ অভিমত দেন ১২ রবিউল আউয়াল মহানবীর (দ.) জন্ম দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে সেদিন থেকে নতুন বছর সূচনা করা হোক। খোলাফায়ে রাশেদার চতুর্থ খলিফা আমিরুল মুমেনিন হযরত মওলা আলী (রা.) মত দেন মহানবীর (দ.) হিজরতের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে হিজরত থেকে ‘হিজরি’ সন নামে নতুন একটি সন প্রবর্তন করা যায়। তৃতীয় খলিফা আমিরুল মুমেনিন হযরত ওসমান (রা.) পরামর্শ দেন মহররম মাস থেকেই যেন সন গণনা শুরু করা হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনেক শলা পরামর্শের মাধ্যমে অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় মহানবীর (দ.) হিজরতকে মহিমান্বিত ও স্মরণীয় করে রাখতে ‘হিজরি’ নামেই নতুন সন প্রবর্তিত হবে। মহানবী (দ.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। আর হিজরি সন প্রবর্তিত হয় এর ১৭ বছর পর ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এই হিজরি সন আজ থেকে দেড় হাজার বছর ধরে মুসলমানদের নিজস্ব সন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বর্তমানে সারা বিশ্বের দুইশ কোটি মুসলমান নিজেদের ইবাদত বন্দেগি এবং ইসলামী জীবনাচার হিজরি সন ও তারিখ মেনে পালন করে আসছে। তাই,হিজরি সনকে আন্তর্জাতিক সনের অভিধাও দেয়া যায়। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, রোজা, পবিত্র হজ্ব, ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.), আশুরা, শবে বরাত, শবে কদর, মে’রাজুন্নবী (দ.), ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম ইত্যাদি ইসলামী উপলক্ষগুলো আমরা হিজরি তারিখ মেনে উদযাপন করি। খ্রিষ্টীয় বা ঈসায়ি সন এবং বাংলা সন নামেও বহুল প্রচলিত দুটি সন এদেশে কার্যকর রয়েছে। ১ বৈশাখ বাংলা নববর্ষে এদেশে সরকারি ছুটি আছে। ১ জানুয়ারি খ্রিষ্টীয় নববর্ষে সরকারি ছুটি না থাকলেও দুঃখজনক যে,মহা ধুমধামে এক শ্রেণির যুবক-যুবতী হৈ হুল্লোড়ে মেতে ওঠে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করে।অথচ এই থার্টি ফার্স্ট নাইট আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নয়। এটি ভিনদেশি আমদানি করা অপসংস্কৃতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এদেশে জাতীয় চেতনামন্ডিত ১ মহররম হিজরি নববর্ষ পালনে এগিয়ে না এসে ১ জানুয়ারি থার্টি ফার্স্ট নাইটে মজে থাকা অবশ্যই আপত্তিকর ও নিন্দনীয়। নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি তাহজিব তমদ্দুন ভুলে অপসংস্কৃতিতে ডুবে থাকা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
আমাদের প্রিয় এ স্বদেশে ইসলাম এনেছেন মহাত্মা আউলিয়ায়ে কেরাম। আজ হতে শত শত বছর আগে চট্টগ্রাম নগরের চেরাগি পাহাড়ে চাটি বা চেরাগ জ্বালিয়েছেন কুতুবুল আউলিয়া হযরত বদর শাহ (রহ.)। এর বহু আগে ইসলামের প্রাথমিক যুগে হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বাংলাদেশে এসে ইসলামের ঝান্ডা উড়িয়েছেন মর্মে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়। গাউসুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.), ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাজী সৈয়দ আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.),কুতুবুল আউলিয়া আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.),রাঙ্গুনিয়া দরবারে বেতাগী আস্তানা শরিফের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব আল্লামা হাফেজ বজলুর রহমান (রহ.) সহ যুগে যুগে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে এতদঞ্চলে ইসলামের ভিত্তি সৌধ গড়ে তুলেন মহাত্মা আউলিয়ায়ে কেরাম। তাঁরা এখানে সুন্নিয়তের বীজ রোপণ করে মুসলমানদেরকে ঈমানি চেতনা ও প্রেরণায় উজ্জীবিত করেন। এরই অংশ হিসেবে ২০১০ সন থেকে চট্টগ্রামে হিজরি নববর্ষ উদযাপন এখানকার মুসলমানদের মাঝে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। হিজরি নববর্ষ বরণে ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
আজ আমাদের সম্ভাবনাময়ী যুব তরুণরা পথভ্রান্ত ও দিশেহারা। তাদেরকে আমরা সরল সঠিক রাস্তার দিশা দিতে পারছি না। তারা সর্বপ্লাবী অবক্ষয়ে উদভ্রান্ত হয়ে হাতড়াচ্ছে। তাদের চোখে মুখে গভীর আঁধার ভর করেছে। অথচ যুব তরুণদের মাঝে ইসলামী কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরে তাদের ঘুমন্ত বিবেককে জাগ্রত করা যায়। অন্ধকারের গভীর গহব্বর থেকে যুব তরুণদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসতে ইসলামী উজ্জীবন ও প্রেরণাধর্মী কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরা দরকার। হিজরি নববর্ষ উদযাপনে চর্চিত ইসলামী সংস্কৃতিকে আজ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। শুধু চট্টগ্রাম নয়,সারা দেশে এমনকি জেলায় জেলায় এবং উপজেলাগুলোতে হিজরি নববর্ষ আয়োজিত হলে বর্তমান প্রজন্ম আদর্শ ও নৈতিক চেতনায় গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এদেশে হিজরি নববর্ষ বেশ সাড়ম্বরে পালিত হওয়া উচিত। এজন্য আমাদের কবি সংবাদিক গবেষক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী এবং উলামা মাশায়েখকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের কিছু সংস্কৃতিসেবী বাংলা নববর্ষ পালনে অনেকটা আগ্রহী-উদ্যমী হলেও হিজরি নববর্ষ উদযাপনে অনেকেই থাকেন নিষ্ক্রিয়,নিশ্চেষ্ট। জাতীয় চেতনা ও জাতীয় আদর্শের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ইসলামী কৃষ্টি সংস্কৃতি সহযোগে হিজরি নববর্ষ উদযাপনে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। আমরা সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই,১ মহররম হিজরি নববর্ষের দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক। দিনটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যেন উদযাপন করা হয়। পত্রিকাগুলো বিশেষ লেখা ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করুক এবং টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান স¤প্রচারে এগিয়ে আসবে আমরা এই আশা করি। আশার কথা যে, এবছরসহ ষোল বছর ধরে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের ব্যানারে চট্টগ্রামে বর্ণাঢ্য আয়োজনে হিজরি নববর্ষ উদযাপন বড় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। হামদ, না’তে রাসূল (দ.), গজল, কাউয়ালি, পুঁথি পাঠ, মরমী, মাইজভান্ডারী গান ও নানা উজ্জীবনধর্মী সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে হিজরি নববর্ষ বরণে এগিয়ে আসছেন বিভিন্ন ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠনের শায়ের ও খুদে শিল্পীরা। হিজরি নববর্ষ বরণে এ ধরনের মহত্তর আয়োজনে উদ্যোগী ও সহযোগী সকলই বিশেষ প্রশংসা ও কৃতিত্বের দাবি রাখে। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৪৭। অশ্রুসিক্ত বিদায় ১৪৪৬।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান : হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ, সাজ্জাদানশিন: দরবার-এ-বেতাগী আস্তানা শরিফ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম