লিটন দাশ গুপ্ত
আজ সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখতে বা বলতে চাই। যদিও এই বিষয়ে বলতে বা লিখতে আমার ব্যক্তিত্ব ও রুচিতে বাধে। তারপরেও সামাজিক অবক্ষয় ও নতুন প্রজন্মের আচরণিক পরিস্থিতি অন্যকে অবগত করার জন্যে আজকের এই ছোট নিবন্ধটি লেখা। গত বেশ কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের আইস ফ্যাক্টরি রোড দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমার একপাশ দিয়ে অর্ধবয়স্ক অপরিচিত এক ভদ্রলোক বা পথিক অনেকটা আমার সমান্তরালে ও সমান তালে হেঁটে যাচ্ছিলেন। টাইস্যুট পরা ভদ্রলোক হেঁটে যাবার ভঙ্গী দেখে মনে হল, তিনি আশেপাশে স্বনামধন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। বিশেষ করে সিটি কলেজ কিংবা ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক মনে করেছি। তবে সিটি কলেজ ক্রস করে যাবার পর বুঝলাম তিনি সিটি কলেজের শিক্ষক নয়। যাইহোক এভাবে আরো কিছু দুর যাবার পর দেখলাম, পিছন থেকে কিছু তরুণ, ভদ্রলোককে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। তাদের বয়স ও চালচলন বেশভুষণ দেখে ছাত্র হবার সম্ভাবনা রয়েছি। এরা ভদ্রলোককে পাশ করে যাবার সময় হাস্যরসাত্বক কণ্ঠে বলছে, ‘মুরব্বি মুরব্বি, উহু হঁ হুঁ হুঁ…!’ অর্থাৎ মুরুব্বি মানে বৃদ্ধব্যক্তি, আর উহু হু হু মানে বুঝাতে চেয়েছে; এভাবে হাঁটে না, একপাশ দিয়ে হাঁটো। কারণ তাদের হেঁটে যাবার অসুবিধা হচ্ছে। আমি বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোক পরিস্থিতির কারণে অন্তঃক্ষুব্ধ হয়েছে। কয়েক সেকেন্ড পর আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক বলছে সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে! আমি বললাম, চোখে দেখা আর কানে শোনা ছাড়া মুখে কিছু বলার নাই। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে সমাজে চুপ থাকায় উত্তম ও নিরাপদ। এইতো গেলো সেই দিনের এই ঘটনা। আরো কয়েকদিন পর কালুরঘাট এলাকায় আরেকটি ঘটনার কথা বলব। সেদিন গাড়ি থেকে নেমে আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি, আমার পিছন দিক থেকে এসে পরিচিত এক শিক্ষক বলছে, ‘স্যার আপনি কি আমাদের গাড়িতে ছিলেন, দেখেছেন ঘটনা?’ আমি ফিরে দেখলাম আবছার সাহেব। বললাম না, কি হয়েছে। আবছার সাহেব বললেন, তাঁর ভাষায়- ‘বহদ্দার হাট থেকে প্রতিদিন ৭ টাকা দিয়ে গাড়ি করে কালুরঘাট আসি। আজ কন্ডাক্টরকে ১০ টাকার নোট দিলে সে ৩ টাকা ফেরত না দিয়ে অন্যদের থেকে ভাড়া উঠাতে থাকে। আমি আমার প্রাপ্য ৩ টাকা খুঁজতে গেলে সে কোন জবাব না দিয়ে তার মত করে ভাড়া উঠাতেই থাকে। আমি যখন কঠোর হয়ে কিছু বলতে যাই, তখন সে বলে, মুরব্বি মুরব্বি উহু হু হু…!’ নুরুল আবছার সাহেবের কথা শুনে ভাবলাম, সে তো আমার চেয়ে বয়সে ছোট। ঘটনাটি তো আমার বেলায়ও হতে পারতো! কয়দিন আগেও দেখলাম আমার সামনে একই ঘটনা ঘটেছে। ঐ ভদ্রলোকটিও ছিলেন আমার প্রায় সমবয়সী। আরো ভাবছিলাম, মানুষ দিন দিন নীতি নৈতিকতা হারাচ্ছে, ভদ্রতা ন¤্রতা কেবল বইয়ে ভাষা! এভাবে বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে আর আবছারের সাথে কথা বলতে বলতে নিজ প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে গেলাম। এই সময়ে কর্মস্থলে প্রবেশ পথে দেয়ালে সাঁটানো আয়নায় হঠাৎ চোখ পরে যায় আমার। দেখতে আমি অসুন্দর হলেও আয়নায় নিজেকে দেখে খানিক খুশী হলাম! কারণ এই বয়সে মাথায় প্রায় ৯৭ শতাংশ চুল কালো রয়েছে। কিন্তু দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম, মাথার চুলের বয়সের চেয়ে, মুখের দাড়ি ১৮+ বছরের ছোট! তারপরেও দাড়ি ৩৫ শতাংশ সাদা হয়ে গেছে! কিন্তু আবছার সাহেবের চুল-দাড়ি শতভাগ সাদা। তাই বয়সে আমার ছোট হলেও ‘মুরব্বি’ শিকার হয়েছে। এইসব ভেবে নিজেই নিজের সান্ত¦না খুঁজে নিলাম!
যাইহোক, এইতো গেল সেদিন চাক্ষুস মুরব্বি শিকারের ২য় ঘটনা। এবার ৩য় একটি ঘটনা বলে আজকের লেখা শেষ করব। যে ঘটনাটি আমার এক সাংবাদিক বন্ধু মোবাইলে বলেছে। তার বলা ঘটনা খুব সংক্ষেপে এই রকম- সেই দিন পেশাগত দায়িত্বপালন শেষে রাতে বাসায় এসে সে দেখে ছোট ছেলেটা বিরক্ত করছে। এটা সেটার বায়না ধরে কান্না করছে আর কিছুই খাচ্ছেনা। অনেক চেষ্টা করেও যখন থামানো যাচ্ছেনা, তাই ব্যর্থ হয়ে সাধারণত যা করা হয় আরকি! বাধ্য হয়ে বেত একটা নিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে থাকে। পিতার এমন অবস্থা দেখে তার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া কন্যা পিছন থেকে এসে বলে, ‘মুরুব্বি মুরুব্বি উহু হু হু হু…!’ মেয়ের এমন আচরণে সাইফুদ্দিন, মানে আমার সাংবাদিক বন্ধু অবাক হয়ে যায়। একটু পরে পরিবেশ শান্ত হলে মেয়ে থেকে সে জানতে চায়, মুরুব্বি হু হু এগুলোর মানে কি? মেয়ে জানায়, ‘বড়জনকে সম্মান করে মুরুব্বি বলে ডাকতে হয়, তারপর কোন অন্যায় বা ভুল হলে বাধা দিতে হু হু হু, মানে না না না বলে বারণ করা হয়। এই হচ্ছে বন্ধুর বর্ণনায় তার পারিবারিক ঘটনা, যা আমাকে সহভাগ করে হয়ত সে শান্তি খুঁজে নিয়েছে। শুরুতেই বলেছি মুরব্বি সংক্রান্ত ট্রলের ঘটনা নিয়ে কিছু লিখতে আমার রুচিতে বাঁধে। কিন্তু এই সাংবাদিক বন্ধু সাইফুদ্দিনের অনুরোধে আজকের এই লেখা। যদিও আমি তাকে লিখতে বলেছি, সে বলেছে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে লিখে সর্বসাধারণকে অবগত করা তার সাংবাদিকতার কাজ। আমি নাকি, তার কথায় শিক্ষা ও সমাজ বিশ্লেষক, তাই উপ-সম্পাদকীয়তে আমি লিখলে ভালো হয় জানায়! যাইহোক এটি শুধু হাস্যরসাত্বক নয়, এই ‘হুহুহু মুরুব্বি মুরুব্বি’ নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে অনেক ঘটনা ঘটেছে, দেখেছি শুনেছি। আমি এই বিষয়ে আর বেশী উদাহরণ দিতে চাচ্ছিনা। এখানে ‘মুরুব্বি মুরুব্বি উহু হু হু হু…’ হচ্ছে স¤প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ার ভাইরাল হওয়া ভিডিওর একাংশ। যা নাকি একটি মাহফিলে ইসলামিক বক্তা মাওলানা মোস্তাক ফয়েজি সাহেবের মুখে প্রথম শোনা যায়। তবে কথা হচ্ছে মানুষ মজা করবে আনন্দ করবে সৌজন্যতা ভদ্রতা সিনিয়র জুনিয়র মর্যাদা বজায় রেখে। কিন্তু ছোট ছোট ছেলে মেয়ে মা-বাবার সমান বয়ষ্ক মানুষের সাথে এই রকম আচরণ করা একপ্রকার বেয়াদবী ছাড়া আর কিছু নয়। পিতৃতুল্য প্রবীণকে পথে ঘাটে যেভাবে নেট দুনিয়ায় ট্রল হওয়া শব্দ দিয়ে বাস্তব আক্রমণ করা হচ্ছে, তা জাতির জন্য বড় অপমান, কলঙ্ক ও লজ্জাজনক। আজকের শিশু, আগামী দিনে কৈশোর যুব প্রৌঢ়কাল অতিক্রম করে, তারাও একদিন বর্ষিয়ান হবে। কথাগুলো তাদের মনে আসা উচিত। যে কথা বলছিলাম,‘মুরুব্বি মুরুব্বি উহু হু হু হু…’ ভাইরাল হওয়া ভিডিওর একাংশ। যা গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে শুধু যে দেশের ভিতরে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তা নয়, বিদেশের মাটিতেও ‘মুরুব্বি মুরুব্বি’ অনুকরণ অনুসরণ করে ভিডিও তৈরী করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। এখন পথে ঘাটে মাঠে মুরুব্বি শব্দটি নিয়ে এতবেশী অপব্যবহার হচ্ছে, যার ফলে সমাজে বয়োজ্যেষ্ট মানুষ অবহেলা ও অসম্মানিত হচ্ছে। আর বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাচ্ছে অপ্রীতিকর ঘটনা। যেমনটা ঘটেছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা জুঁইদন্ডী গ্রামে। পিতামাতাহীন ১৩/১৪ বছর বয়সী পপি আক্তার সম্পর্কীয় মামার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পপি তার নানীকে মজার ছলে ‘মুরুব্বি মুরুব্বি হুহুহু’ বলায় ক্ষুব্ধ নানী টাটকা গরম পানি ঢেলে পপির শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে ঝলসে দেয়। পত্রিকায় যে ধরনের ভয়াবহতার খবর পেয়েছি, এখন বেঁচে আছে কিনা জানিনা। এই ভাবে ঘটে যাচ্ছে অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা। যার খবর কিছু পাচ্ছি কিছু পাচ্ছিনা।
যাইহোক, আমরা সবসময়ই জানি আমাদের যুবসমাজ অনাগত দিনের ধারক বাহক। তারা জাতির ভবিষ্যত যা অতীত ইতিহাসে অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ রেখেছে। এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে নাকি পিছিয়ে যাবে, নাকি স্থবির হয়ে পড়বে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে এই নতুন তরুণ প্রজন্ম কেমন তাদের উপর। তাই এই বিষয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট