আহসানুল কবির রিটন
১৯৭১ সালের উত্তাল যুদ্ধের দিন। সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নানা প্রান্তেও মুক্তিকামী যুবকরা মাতৃভুমি রক্ষায় যুদ্ধ করছিলো জীবনবাজী রেখে। এসময় ফটিকছড়ির পূর্ব ধর্মপুর এলাকায় যুদ্ধরত যুবকরা যখনই বিপদ আঁচ করতো তখনই তারা ছুটে যেতো আরব ফকির শাহ (রহ.) মাজারে। সেখানে মাজার জেয়ারতের পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতো। আর শত্রুপক্ষ একেবারেই কাছাকাছি চলে এলে মুক্তিযোদ্ধারা এই মাজারের পাশে আত্মগোপনে চলে যেতো। যে কারণে পাঞ্জাবিরা মাজার ও তদসংলগ্ন এলাকা এড়িয়ে চলতো। এমন কথা উঠে এসেছে মাইজভান্ডার গাউসিয়া আহম্মদিয়া মঞ্জিলের খাদেম ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুহম্মদ ইদ্রিসের মুখে।
চলুন দেখি কে এই আরব ফকির শাহ (রহ.) ?
যুগে যুগে ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশের পবিত্র ভুমিতে এসেছেন অসংখ্য পীর আউলিয়া। সেই ধারাবাহিকতায় বারআওলিয়ার পুণ্যভুমি চট্টগ্রামে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রহঃ), হযরত শেখ ফরিদ (রহ.), হযরত শাহ আমানত (রহ.), হযরত বদর শাহ (রহ.), হযরত মোল্লা মিসকিন শাহ (রহ.), হযরত মুফতি গরিবুল্লাহ শাহ (রহ.), হযরত মোহসেন আউলিয়া (রহ.), হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.)সহ আরো অনেক আউলিয়া। আর এই উপমহাদেশের আধ্যাত্ম শরাফতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত কেবলা খ্যাত গাউসুল আজম সৈয়দ আহম্মদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.), বাবা ভান্ডারি খ্যাত হযরত মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারি (ক.), অছিয়ে গাউসুল আজম হযরত মাওলানা সৈয়দ দেলাওর রহমান মাইজভান্ডারি (ক.), বিশ্বঅলি শাহানশাহ মাওলানা হযরত শাহসূফি সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারি (ক.) জন্ম হয়েছিলো চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাটিতেই।
ফটিকছড়ি খিরাম কাদেরিয়া মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা ওমর ফারুক আজমি ও স্থানীয় মুরুব্বীদের মতে, এখন থেকে কয়েকশত বছর আগে পূর্ব ধর্মপুর গ্রামের জঙ্গলাকির্ণ এলাকায় ঠিক কখন হযরত আরব ফকির শাহ (রহ.) আল-আরবী এসেছিলেন তার কোন সঠিক সন-তারিখ কারো জানা নেই। তবে এলাকার আলেম-ওলেমা ও বিজ্ঞজনের মতে, মোঘল শাসন আমলে হযরত আরব ফকির শাহ (রহ.), হযরত আদম ফকির শাহ (রহ.), হযরত হায়াতি ফকির শাহ (রহ.) এবং শাহী ফকির শাহ (রহ.) তারা আপন চার ভাই। তারা একসাথে বাংলাদেশে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হলো এলাকায় ইসলাম প্রচার করা। তারা যখন পূর্ব ধর্মপুর এলাকায় আসেন তখন উক্ত এলাকা ছিলো গহীন অরণ্যঘেরা। বাঘ-ভালুকের মতো হিং¯্র প্রাণীর তখন সেখানে অবাধে চলাচল। নিজেদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে মোরাকাবা-মোশাহেদার মাধ্যমে সেসব হিংগ্র জন্তুকে বশ করে রাখতেন। চালিয়ে যেতেন নিবিড় সাধনা। চলতে থাকে আশপাশের গ্রামে ইসলাম প্রচার। চারদিকে ইসলামী শরীয়ত ও তরীক্বতের প্রসার বাড়তে থাকে। একই সাথে ছড়াতে থাকে হযরত আরব শাহ ফকিরের নামযশ। বিপদগ্রস্থ মানুষ আসতে থাকে তার কাছে। তিনি লোকজনের বিপদমুক্তি কামনা করে আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো।
আলেম-ওলামাদের মতে, আরব শাহ ফকির ছিলেন মোস্তায়বুদ দাওয়াত। অর্থাৎ তিনি কিছু নিয়ে দোয়া করতেন সাথে সাথে তা কবুল হয়ে যেতো। হযরত আরব ফকির শাহ (রহ.) ও হযরত হায়াতি ফকির শাহ (রহ.) এর মাজারের মাঝে দুরত্ব ছিলো অন্তত ২ কিলোমিটার। জানা যায়, এই দুই অলিয়ে কামেলের বাড়িতে কখনো চোর-ডাকাত প্রবেশ করতো না। ভুলবশতঃ কেউ প্রবেশ করলেও সে আর বাহির হতে পারতো না। পরক্ষণে সে চোর-ডাকাত ভুল স্বীকার করে এই মহান অলিদের মাজার শরীফে নিজ দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতো। এমন অনেক ঘটনা এলাকাবাসীর মুখে প্রচলিত আছে। তারা আপন মওলার ধ্যানে সংসার ত্যাগ করে ফকিরি জীবন যাপন করেছেন বলে তাদের কদমে চুম্বন করেছে বনের হিংস্র প্রাণী। স্বীকার করছে তাঁদের বশ্যতা। পরবর্তীতে এখন থেকে শতবছর আগে এলাকার পরহেজগার ও আল্লাহপ্রেমী লোকজনকে স্বপ্ন যোগে বাংলা ২৮ পৌষ ফাতেহা ও ওরশ করার নির্দেশে হযরত আরব ফকির শাহ। সেই থেকে শুরুতে ছোট পরিসরে ও বর্তমানে বেশ জাঁকজমকের সাথে হযরত আরব ফকির শাহ (রহ.) এর বার্ষিক ওরশ শরীফ করে আসছে এলাকাবাসী। ওরশে আলেম-ওলামা, শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো মানুষের সমাগম ঘটে।
বেশ কয়েক বছর ধরে কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে ওরশ। বর্তমানে এই ওরশ শরীফ উদযাপন করতে ওস্তাদুল ওলামা হযরত মাওলানা ফজলুল বারী আব্বাসী (র.)। নানা সময়ে এই মাজারের খেদমতে কাজ করেছেন মরহুম সোরত আলী মুন্সি, মরহুম আবদুর রশিদ, মরহুম আবদুল লতিফ, মরহুম নুরুল হক মেম্বার,মাওলানা শাহাদাত হোসেন,মরহুম শফি সওদাগর,মরহুম আবু তাহেরসহ আরো অনেকে। তবে ইসলামের খেদমতে সুদুর আরব দেশ থেকে আসা হযরত আরব ফকির শাহ (রহঃ) এর মাজারটি দীর্ঘদিন যাবৎ জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। এটি সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছে বর্তমান ওরশ পরিচালনা কমিটি। আর এজন্য সমাজের খোদাভিরু দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তা কামনা করেছেন তারা।
লেখক : সাংবাদিক