রিয়াসাদ সানভী
ঢাকা ছাড়ার সময় দেখে এসেছি পরিষ্কার আকাশ। মধ্যরাতের পর কুমিল্লার সীমানা পার হতেই ঠান্ডা হাওয়া বাসের জানালা গলে ঝাপটা মারতে লাগল শরীরে। সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটা। খুব ভোরে যখন নয়দুয়ারী বাজারে নামলাম, ততক্ষণে পুরো মিরসরাই এলাকা বৃষ্টিতে কাকভেজা। টিপরাখুমের পথ ধরলাম। বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত গ্রামীণ পথ পেরিয়ে, ধানক্ষেত পেছনে ফেলে পুবদিকে সোজা সবুজ পাহাড়ের সারি। আমরা চলেছি সেদিকেই। পাহাড় থেকে ঝিরি নেমে এসে লোকালয়ের দিকে গেছে। টিপরাখুম থেকে সেই ঝিরি ধরে এগোতে লাগলাম আমরা। মিনিট বিশ-পঁচিশ হেঁটেই দেখা পাওয়া গেল দিনের প্রথম বিস্ময়ের। পাথরের মসৃণ দেয়াল নেমে এসেছে ঝিরিপথে। গড়িয়ে পড়ছে পানির ধারা। এর নাম ছোট নাপিত্তাছড়া ঝরনা।
এর পরের গন্তব্য বান্দরখুম। যেতে হবে নাপিত্তাছড়া ঝরনা পার হয়ে। এবার খাড়া পাহাড় বাইতে হবে। নাপিত্তাছড়া ঝরনার উৎসমুখের পাশেই পাহাড় উঠে গেছে আকাশমুখী। পিচ্ছিল সে পথ ভয় ধরালেও অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ সে ভয় তাড়াল। ওপরে উঠে দেখা মিলল এ এলাকার স্কাইলাইনের। ভরা বর্ষা মৌসুম শেষ হয়েছে। কিন্তু রেশ কাটেনি। স্বভাবতই সবুজে সবুজময় চারপাশ। ট্রেইল ধরে এগোতে লাগলাম আমরা। যদিও ১০ মিনিটের মধ্যেই আবার নামতে হলো ঝিরিতে। বান্দরখুম ঝরনার রূপ শিহরন জাগানো। সেই উত্তেজনা বাকিটা পথ আচ্ছন্ন করে রাখায় পথের দূরত্ব কষ্টের কারণ হয়নি। ঝিরিতে বেশ পানি। পায়ের পাতা ছাড়িয়ে সে স্রোত মাঝেমধ্যেই উঠে আসছে হাঁটু পর্যন্ত। বেশ বড় কয়েকটি পাথর পেরোতেই খানিক দূরে গাছের ফাঁকে চোখে পড়ল বান্দরখুম ঝরনার ওপরের অংশ। সোজা আকাশের পানে উঠে যাওয়া দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি নেমে এসেছে ঝরনাধারা। নেমে আবার নিচের পাথরে পড়ে ভাগ হয়ে গেছে তিনটি। কাছাকাছি আছে আরেকটি ঝরনা। নাম বাঘবিয়ান। এর উচ্চতা আরও বেশি। বান্দরখুম থেকে একদমই যেতে মন চাইছিল না।
সুপ্তধারা, সহস্রধারা: আমরা চলে এসেছি সীতাকুন্ড বাজারে। সীতাকুন্ড বাজার থেকে খুবই কাছে এ ইকোপার্ক। জনপ্রতি ২০-২৫ টাকা ভাড়া দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় পার্কের গেটে। উঁচুনিচু পিচঢালা বৃষ্টিধোয়া পথে চললাম জাগ্রত সুপ্তধারা দর্শনে। গেট থেকে হাঁটা শুরু করলে প্রথমে সুপ্তধারায় যাওয়ার নির্দেশনা আছে। পাহাড়ি পথে এখানে সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে একেবারে ঝিরিপথ পর্যন্ত। আমরা সে পথেই নেমে গেলাম ঝিরিতে। নেমেই বুঝলাম প্রকৃতিদেব আমাদের প্রতি প্রসন্ন। পানিতে টইটম্বুর ঝিরি। তার মানে সুপ্তধারায় বৃষ্টিধোয়া জলের বান ডেকেছে। বেশ কয়েকবার ঝিরি এপার-ওপার করতে হলো। জঙ্গলের পথে কিছুটা হাঁটতেও হলো।
শেষের দিকে ঝিরি মোটামুটি মসৃণ। শেষ বাঁকটি ঘুরতেই প্রথম দর্শনে মাথা একেবারে ঘুরিয়ে দিল সুপ্তধারার গর্জন। পাথুরে আড়াআড়ি মঞ্চের পুরোটা জুড়ে ঢল নেমেছে। কিছুক্ষণ পর সুপ্তধারার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল হয়ে গেল। ভয়াবহ সুন্দর কোনো কিছুর স্বাদ অল্প করে নিতে হয়। তাহলে মানসপটে অনেক দিন পর্যন্ত তা জাগ্রত থাকে। এবার সহস্রধারার পথে। এ নামে অবশ্য আরেকটি ঝরনা আছে। কাছাকাছি অঞ্চলেই। এটি মূলত সহস্রধারা-২ নামে পরিচিত। ভরা বর্ষার স্পর্শ পেয়ে সে তোড়জোড় শুরু করেছে। ঢাকা থেকে এলে সীতাকুÐ বাজারে নামাই ভালো। সীতাকুÐ-মিরসরাই অঞ্চলে আছে অসাধারণ কিছু ঝরনাধারা। এ অঞ্চলের অন্যতম সুবিধা হলো দিনে দিনেই এসব ঝরনার বেশ কয়েকটি দেখে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে ফিরতে পারবেন। এমনই কয়েকটি ঝরনায় যাওয়ার রুট প্ল্যান দেওয়া হলো।
খৈয়াছড়া ঝরনা: সীতাকুন্ড-মিরসরাই জোনের সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য খৈয়াছড়া ঝরনা। ঢাকা থেকে গেলে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে মিরসরাই বাজারের আগে বড়তাকিয়া বাজারে নেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে খৈয়াছড়া যাওয়ার রাস্তা।
নাপিত্তাছড়া ট্রেইল: এ ট্রেইলে বাঘবিয়ান, বান্দরখুম ও নাপিত্তাছড়া নামে তিনটি ঝরনা আছে। ঢাকা থেকে গেলে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারী বাজারে নেমে পুবদিকের রাস্তা ধরে আধঘণ্টা বা পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটলে নাপিত্তাছড়া ট্রেইল পাবেন।
সুপ্তধারা-সহস্রধারা-১ ট্রেইল: সীতাকুন্ড ইকোপার্কের ভেতরে আছে অসাধারণ দুটি ঝরনা সহস্রধারা ও সুপ্তধারা। ২০ টাকা দিয়ে পার্কের টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে দিকনির্দেশক চিহ্ন ধরে হাঁটলে পেয়ে যাবেন ঝরনা দুটি।
সহস্রধারা-২ (মূল সহস্রধারা) ট্রেইল: ঢাকা থেকে গেলে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে সীতাকুন্ডের ছোট দারোগারহাট বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে সাইনবোর্ড নির্দেশিত পথে পুবদিকে যেতে হবে।
বড় কমলদহ ঝরনা: সেখানে যেতে হলে আসতে হবে বড় দারোগারহাট বাজারে। সেখান থেকে পুবদিকের পথ ধরতে হবে।
বাড়বকুন্ড ট্রেইল: এ ট্রেইলে আছে চারপাশে পাহাড়ঘেরা বহু পুরোনো কালভৈরবী মন্দির। এখানে আছে বাংলাদেশের একমাত্র গরম পানির ঝরনা। বাসে সীতাকুন্ডের বাড়ববকু বাজারে নামতে হবে। এরপর পুবদিকের রাস্তা ধরে ১ ঘণ্টার মতো হাঁটলেই কালভৈরবী মন্দির পেয়ে যাবেন। বাকি পথ ছড়া ধরে গেলেই হবে।
হরিণমারা-হাঁটুভাঙা-সর্পপ্রপাত ট্রেইল: অসাধারণ এ ট্রেইলে আছে চমৎকার নীলাম্বর হ্রদ। পরপর পাবেন চারটি ঝরনা। হরিণমারা ঝরন, হাঁটুভাঙ্গা ঝরনা, বাওয়াছড়ার মুখ ও সর্পপ্রপাত। সীতাকুন্ডের আগে ছোট কমলদহ বাইপাসের শুরুতে নেমে পুবদিকে হাঁটা শুরু করলে একসময় পথই আপনাকে নিয়ে যাবে অনিন্দ্যসুন্দর এসব জায়গায়।
ভ্রমণে ফ্ল্যাশ ফ্লাড: ফ্ল্যাশ ফ্লাড হলো আচমকা পাহাড়ি বান বা পানির স্রোত। কোনো এক শুকনো ঝিরি দিয়ে যাচ্ছেন ঝরনা দেখার উদ্দেশ্যে। আপনার আশপাশে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলেন বিশাল পানির স্রোত ঝিরিকে পূর্ণ করে দিয়ে চলে গেল। এটিই হচ্ছে ফ্ল্যাশ ফ্লাড। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের প্রচন্ড স্রোতে অনেক সময় ভেসে আসে বড় বড় পাথর, গাছের ডালপালা।
ফ্ল্যাশ ফ্লাড কেন হয়: সমতলের তুলনায় পাহাড়ে সাধারণত বৃষ্টিপাত বেশি হয়। আর সেসব বৃষ্টির পানি পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে একত্র হয়ে নির্দিষ্ট কিছু পানিপ্রবাহের পথ ধরে বয়ে চলে। ঝরনাগুলোও কিন্তু তেমনি এক কারণে সৃষ্টি। বিশাল অঞ্চলের পানি একত্রে বয়ে চলার কারণে সরু ঝিরিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়। পাহাড়ে ঝিরিগুলো ছাড়া আর কোনো পানিপ্রবাহের রাস্তা না থাকার ফলে অল্প সময়ে সমগ্র অঞ্চলের পানি মিশে তৈরি হয় বিশাল পাহাড়ি ঢলের স্রোত।
ফ্ল্যাশ ফ্লাড হলে বুঝব কীভাবে: বর্ষাকালেই বেশি ফ্ল্যাশ ফ্লাডের ঘটনা ঘটে, তবে বর্ষাকাল ছাড়াও বৃষ্টির কারণে যেকোনো সময় ঘটতে পারে। আপনার আশপাশে অথবা দূরে বৃষ্টি হলে। ঝিরি বা খালের পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে থাকলে, পানির স্রোতের সঙ্গে গাছের ভাঙা ডালপালা বা পাতা ভেসে আসতে থাকলে ও হঠাৎ ঘোলা পানির স্রোত আসা শুরু হলে বুঝবেন ফ্ল্যাশ ফ্লাড হতে পারে।
করণীয়: পাহাড় ভ্রমণে সতর্ক থাকুন, বিশেষ করে ঝিরি ও খালপথে। বৃষ্টি হলে বা সামনে বৃষ্টি হচ্ছে এমন হলে সতর্ক ও ঝিরি খালের দিকে খেয়াল রাখুন। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের সম্মুখীন হয়ে গেলে মাথা ঠান্ডা রাখুন। খাল বা ঝিরি থেকে দ্রæত পাশের পাহাড়ের উঁচু নিরাপদ জায়গায় ওঠে পড়ুন। ভুলেও ঝিরি বা খালের মাঝে কোনো পাথরে বা অন্য কিছুতে অবস্থান করবেন না। নিরাপদ মনে না হওয়া পর্যন্ত খাল বা ঝিরিতে নামবেন না। মনে রাখবেন ফ্ল্যাশ ফ্লাডের স্রোতে আপনি যত ভালো সাঁতার জানেন না কেন, তা কাজে দেবে না। সব টিমমেট একে অন্যকে সাহায্য করবেন।
সঙ্গে কী নেওয়া ভালো: বর্ষায় কোথাও গেলে সঙ্গে দড়ি, পলিব্যাগ, ছুরি, টর্চ, লাঠি, লবণ নেওয়া ভালো। ফ্ল্যাশ ফ্লাড শুরু হয়ে আবার কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এটা এত দ্রুত আসে যে, সঠিক সময়ে সতর্ক না হলে দেখা যাবে আপনি কোনদিকে ভেসে যাচ্ছেন, নিজেও বুঝতে পারবেন না।
আকাশ খারাপ করছে, বৃষ্টি হতে ফ্ল্যাশ ফ্লাড নিয়ে এতটাই মারাত্মক যে এর কারণে মানুষ মারা যেতে পারে। শুকনো হাঁটুপানির ঝিরি মুহূর্তেই মাথা ছাড়িয়ে যাওয়া পানিতে পরিণত হয়। সীতাকুন্ড, মিরসরাই এলাকায় বেশকিছু ঝিরিপথে ভরা বর্ষায় ট্র্যাকিং করতে গিয়ে চরম বিপদে পড়েছেন অনেকে। তাই সাবধানতা প্রয়োজন হলে ঝিরিপথ থেকে দূরে থাকুন। আর চোখ কান-খোলা রাখুন সর্বোচ্চ পর্যায়ে।