মিরসরাইয়ে বিএনপির দুই গ্রুপে ব্যাপক সংঘর্ষ

3

মিরসরাই প্রতিনিধি

মিরসরাইয়ে পহেলা বৈশাখে বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আয়োজিত আনন্দ শোভাযাত্রা রূপ নিয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। গত সোমবার (১৪ এপ্রিল) দিনভর মিরসরাই পৌরসদরে বিএনপির দুই গ্রুপের সশস্ত্র ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াকে ঘিরে ছিল আতঙ্ক আর উত্তেজনা। দুই পক্ষের হামলায় প্রায় ১০ নেতা-কর্মী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসময় ১টি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।
হামলায় আহতরা হলেন বিএনপি নেতা বাদশাহ (৪২), আনোয়ার হোসেন (৪৮), শহিদুল ইসলাম (৫২), আলা উদ্দিন (৩৮), সাখাওয়াত হোসেন (২৮), সাদ্দাম হোসেন (২৮)। আহতদের উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পহেলা বৈশাখে বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোমবার সকালে মিরসরাই সদরে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়াম্যান নুরুল আমিন সমর্থিত নেতা-কর্মীরা। শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন সাবেক উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব গাজী নিজাম উদ্দিন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর। মিছিল শেষে যাওয়ার পথে যুবদল কর্মী রিয়াদ ও বিএনপি নেতা বাদশাহ’র মধ্যে হাতাহাতি হয়।
পরবর্তীতে দুপুর সাড়ে ৩ টায় উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক আবদুল আউয়াল চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম আহব্বায়ক সালা উদ্দিন সেলিম, সদস্য সচিব আজিজুর রহমান চৌধুরী ও বারইয়ারহাট পৌর বিএনপির আহব্বায়ক মাঈন উদ্দিন লিটনের নেতৃত্বে আরেকটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। এসময় বেশকিছু নেতা-কর্মীর হাতে গাছের লাঠি দেখা যায়। শোভাযাত্রা শেষে তারা চলে গেলেও তাদের গ্রুপের কিছু নেতা-কর্মী মিরসরাই কোর্ট রোডে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। বৈশাখী আনন্দ শোভাযাত্রার সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সতর্ক পাহারায় ছিল।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যান গ্রুপের মিরসরাই উপজেলা যুবদলের আহব্বায়ক কামাল উদ্দিন ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শাহ মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিনের নেতৃত্বে মিরসরাই পৌর সদরে আরেকটি মিছিল বের করা হয়। এসময় নেতা-কর্মীদের হাতে গাছের লাঠি দেখা যায়। এই মিছিল থেকে হঠাৎ করেই একাধিক ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। মহাসড়কের ঢাকামুখী অংশে বসে শ্লোগান দেয় কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে থাকা নেতা-কর্মীরা। পরে মিছিল নিয়ে তারা মিরসরাই কালী বাড়ী মন্দিরের সামনে গিয়ে চট্টগ্রামমুখী অংশে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। এসময় তাদেরকে মহাসড়কের উপর দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিতে দেখা যায়। এসময় দুই গ্রুপের মধ্যে শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উপজেলা সদরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সড়ক দখল করে মিছিল- শ্লোগারে কারণে মহাসড়কে তীব্র যানজট দেখা দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়।
এদিকে সোমবার সকালে করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর গ্রামে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় শহিদুল ইসলাম (৫২) ও আলা উদ্দিন (৩৮) নামে দুই জন আহত হন। শহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিনের অনুসারী এবং আলা উদ্দিন আরেক যুগ্ম আহব্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যানের অনুসারী। বিএনপি নেতা আলা উদ্দিনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, করেরহাট ইউনিয়ন বিএনপির কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছে কিছুদিন ধরে। তারই রেশ ধরে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে দলটির নেতা-কর্মীরা জানান। সোমবার বিকেলে মিরসরাই সদরে আনন্দ শোভাযাত্রা শেষ করে যাওয়ার পথে সাখাওয়াত হোসেন (২৮) নামে এক যুবদল কর্মীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটে। সাখাওয়াত হোসেন উপজেলা ছাত্রদলের আহব্বায়ক সরোয়ার হোসেন রুবেলের ছোট ভাই। সাখাওয়াতকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যানের অনুসারী উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব গাজী নিজাম উদ্দিন বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকালে আমরা দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মিরসরাই সদরে বৈশাখী আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করি। কর্মসূচি শেষে সবাই শান্তিপূর্ণভাবে চলে যায়। বিকেলে কৃষকদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা মিছিল বের করার জন্য মিরসরাই পৌর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব জাহিদ হোসেনের অফিসে অবস্থান নিলে অপর গ্রুপের নেতা-কর্মীরা গিয়ে হামলা করে ও অফিস ভাঙচুর করে। এসময় ২-৩ জন নেতা-কর্মী আহত হয়। এরপর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে নেতা-কর্মীরা গিয়ে পৌর সদরে মিছিল করে শান্তিপূর্ণভাবে চলে যায়।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক নুরুল আমিনের অনুসারী উপজেলা বিএনপির আহব্বায়ক আবদুল আউয়াল চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে দলীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ে আমরা দুপুরে মিরসরাই পৌর সদরে আনন্দ শোভাযাত্রার মিছিল বের করি। মিছিল শেষে আমাদের নেতা-কর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে চলে যায়। এসময় সংঘর্ষের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ফাহিম জালাল বলেন, সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় হামলায় ১৫-২০ জন আহত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহত ৫-৬ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুর রহমান বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসময় পুলিশ সতর্ক অবস্থানে ছিলো। মহাসড়কে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এবিষয়ে থানায় কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, বিএনপির মিরসরাই উপজেলা আহব্বায়ক কমিটি, মিরসরাই পৌরসভা আহব্বায়ক কমিটি এবং বারইয়ারহাট পৌরসভা আহব্বায়ক কমিটি গত ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহব্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার অনুমোদন দেন। ৩টি আহব্বায়ক কমিটিতে আহব্বায়ক ও সদস্য সচিব করা হয় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহব্বায়ক নুরুল আমিনের অনুসারীদের। কমিটিতে যুগ্ম আহব্বায়ক ও সদস্য পদে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আরেক যুগ্ম আহব্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যানের অনুসারীদের রাখা হয়। এতে করে বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা ২৫ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ ও ঝাড়ু মিছিল করেন। পরে ২৬ মার্চ দুই পক্ষ মিরসরাই উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ, কমিটির পক্ষে আনন্দ মিছিল ও বিপক্ষে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করলে সহিংসতা এড়াতে উপজেলা প্রশাসন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ১৪৪ ধারা জারি করে। এসময় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যান গ্রুপের গাজী নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে বিএনপির একটি পক্ষ ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ করেন। ওইদিন বারইয়ারহাট পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক মাঈন উদ্দিন লিটন ও সাবেক আহব্বায়ক দিদারুল আলম মিয়াজীর গ্রুপের মধ্যে বারইয়ারহাট পৌরসভায় সংঘর্ষে জাবেদ নামে এক যুবক নিহত হয়। এই ঘটনায় ৩০ নেতা-কর্মী আহত হয়। পরবর্তীতে গত ৩০ মার্চ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহব্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার মিরসরাই উপজেলা, মিরসরাই পৌরসভা ও বারইয়ারহাট পৌরসভা বিএনপির আহব্বায়ক কমিটির কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত ঘোষণা করেন।