মাহে রমযান : ফাযায়েল ও মাসায়েল

1

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হচ্ছে মাহে রমযান। যে মাসের সম্মানার্থে আল্লাহ তা’আলা বেহেস্তের দরজাগুলো উন্মুক্ত করে দেন, দোযখের দ্বারসমূহ বন্ধ করে দেন এবং অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দী করে রাখেন। যে মহান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআন। আর কুরআন অবতীর্ণ হওয়া মানেই সকল প্রকার কল্যাণের শুভ সূচনা হওয়া। যে মাস আগমনের দুই মাস আগ থেকেই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিতেন। তিনি রজবের শুরুতেই নিজেও এই দোয়াটি পাঠ করতেন এবং সাহাবায়ে কিরামকেও পাঠ করার জন্য শিক্ষা দিতেন, “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবিঁও ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদ্বান” অর্থ: হে আল্লাহ! রজব এবং শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় কর এবং আমাদের রমযানের পুণ্যময় মাস অর্জনের সৌভাগ্য দান কর। (ত্ববরানী-৩৯৩৯)
মাহে রমযান এমনই এক বরকতময় মাস, যার আগমনে পুলকিত হয়ে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের মোবারকবাদ পেশ করতেন। তিনি এই মর্মে সুসংবাদ প্রদান করতেন যে, “তোমাদের কাছে রমযানের পবিত্র মাস এসেছে, যে মাসে আল্লাহ তোমাদের ওপর রোযা ফরয করেছেন।’ (নাসায়ী-২১০৬)
নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ঘোষণার প্রেক্ষিতেই বিশ্বের মুসলমানরা রমযান আসার আগ থেকেই এর জন্য প্রতি বছর প্রস্তুতি গ্রহন করেন। সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেয়ীন, তবে তাবেয়ীন, মুহাদ্দিসীন, আইম্মায়ে মুজাতাহিদীনসহ সর্বস্তরের মুসলমানগণ নিজ নিজ পরিসরে রমযানের প্রস্তুতি নিয়ে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। মুয়াল্লা বিন ফদল বলেন, “সালফে ছালেহীন বৎসরের ছয় মাসব্যাপী দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন, আর বাকী ছয় মাস দোয়া করতেন যেন আল্লাহ তাআলা তাঁদের রমযান কবুল করে নেন।” আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “মানুষ যদি জানতো রমযানে কী কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তাহলে তারা কামনা করতো সারা বৎসর যেন রমযান হয়।” (মাজমাইয যাওয়ায়েদ-৩/১৪১)
তাই মাহে রমযানে রোযার প্রস্তুতির জন্য পূর্বশর্ত হল, সহিহ-শুদ্ধভাবে আবশ্যকীয় বিধি-বিধান তথা শরিয়তের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা।
রোযার কিছু প্রয়োজনীয় মাসায়েল :
রোযা কার উপর ফরয ? রোযা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। রোযা ফরয হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে। ১-মুসলিম হওয়া। ২- আকেল বা বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া। ৩-বালেগ হওয়া বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া।
কার জন্য রোযা ভাঙ্গার অনুমতি রয়েছে ? দুটি অবস্থায় সাময়িকভাবে রমযান মাসেও রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে রমযানের পরবর্তীতে তাকে এই রোযা অবশ্যই কাযা আদায় করতে হবে।
প্রথমত-অসুস্থ : যদি রোযা রাখলে তার রোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়, অথবা অন্য কোনো নতুন রোগ দেখা দেয়ার আশঙ্কা হয়, অথবা রোগমুক্তি বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে রোযা ছেড়ে দেয়ার অনুমতি রয়েছে। অসুস্থ অবস্থায় রোযা ছাড়তে হলে অবশ্যই কোনো ঈমানদার চিকিৎসকের পরামর্শ বা প্রেসক্রিপশন থাকতে হবে, অথবা এ বিষয়ে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
দ্বিতীয়ত- মুসাফির: কেউ যদি নিজ এলাকা থেকে ৬১ মাইল বা ৯৮ কিলোমিটার দ‚রে যাওয়ার এবং সেখানে পৌঁছে ১৫ দিনের কম সময় থাকার নিয়ত করে তাহলে নিজ এলাকা থেকে বের হওয়ার পর থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত সে মুসাফির। সেই অবস্থায় সেই সময়ের বা সেই দিনগুলোর রোযা রাখা যদি কষ্টসাধ্য হয় তবে সে ওই দিনগুলোতে না রেখে পরবর্তীতে কাযা করতে পারবে।
একইভাবে গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মা রোযা রাখলে যদি নিজের জীবনের বা সন্তানের জীবনের ঝুঁকি থাকে, বা রোযা রাখলে দুগ্ধ শুকিয়ে যাবে আর সন্তানের কষ্ট হবে; এরূপ বিষয়ে নিশ্চিত হলে তখন তার জন্য রোযা ছেড়ে দেয়া বৈধ। পরে তা কাযা আদায় করে নিতে হবে। স্ত্রীলোকদের মাসিক পিরিয়ডের সময় রোযা ছেড়ে দিতে হবে। একইভাবে কোনো স্ত্রীলোকের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর রক্তক্ষরণের সময় (যাকে শরীয়তের ভাষায় ‘নিফাস’ বলা হয় এবং যার সর্বোচ্চ সময় হল ৪০ দিন, সর্বনিম্ন কোনও সময় নেই) রোযা ছেড়ে দিতে হবে এবং এ সব ক্ষেত্রে পরে তা কাযা আদায় করে নিতে হবে।
যে সব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হয় :
নির্ধারিত কিছু শর্ত ও রোকন আদায়ের মাধ্যমে রোযা সম্পন্ন করতে হয়। এ সব শর্ত ও রোকন পাওয়া না গেলে রোযা ভেঙে যায় এবং তা বাতিল বলে গণ্য হয়। শরিয়ত অনুমোদিত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তির জন্য রোযা ভঙ্গ করা কবিরা গুনাহ। ইসলামী শরিয়তে রোযা ভঙ্গ করার প্রতিবিধান রাখলেও তার শত ভাগ ক্ষতিপূরণ কখনও সম্ভব নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি (শরিয়ত অনুমোদিত) কোনো কারণ ছাড়া বা রোগ ছাড়া রমযান মাসের একটি রোযা ভেঙে ফেলল, তার পুরো জীবনের রোযা দিয়েও এর ক্ষতিপূরণ হবে না। যদিও সে জীবনভর রোযা রাখে।’ (তিরমিযী: ৭২৩)
তাই যেসব কারণে রোযা ভেঙে যায় এবং কাযা ও কাফ্ফারা উভয়টি আদায় করতে হয় তা হল: রোযাবস্থায় স্ত্রী-সম্ভোগ ও ইচ্ছাকৃত পানাহার।
যে সব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং শুধু কাযা আদায় করতে হয়; কাফফারা দিতে হয় না :
১. ইচ্ছা করে বমি করা। ২. বমির বেশির ভাগ মুখে আসার পর তা গিলে ফেলা। ৩. মেয়েদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাবাস্থা। ৪. ইসলাম ত্যাগ করলে। ৫. গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন দিলে। ৬. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় গলার ভেতর পানি প্রবেশ করলে। ৭. প্রস্রাব-পায়খানার রাস্তা দিয়ে ওষুধ বা অন্য কিছু শরীরে প্রবেশ করালে। ৮. রোযাদারকে জোর করে কেউ কিছু খাওয়ালে। ৯. রাত অবশিষ্ট আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর পানাহার করলে। ১০. ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে সূর্যাস্তের আগে ইফতার করলে। ১১. ভুলবশত কোনো কিছু খাওয়ার পর রোযা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছা করে আরো কিছু খেলে, ১২. বৃষ্টির পানি মুখে পড়ার পর তা খেয়ে ফেললে। ১৩. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করালে। ১৪. জিহব্বা দিয়ে দাঁতের ফাঁক থেকে ছোলা পরিমাণ কোনো কিছু বের করে খেয়ে ফেললে। ১৫. অল্প বমি মুখে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেললে।
রোযার কাযা ও কাফফারা কী? রোযার কাযা হলো, একটি রোযার পরিবর্তে শুধু একটি রোযা আদায় করা। আর রোযার কাফফারা হলো, তিনটি মাধ্যমের যে কোন একটি মাধ্যম অবলম্বন করা। ১-দাস বা দাসী মুক্ত করা। ২- ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোযা পালন করা। ৩- ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা ভালোভাবে তৃপ্তিসহকারে আহার করানো।
যেসব কারণে রোযা মাকরুহ হয়: ১. বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছু চিবালে। ২. মাজন, কয়লা, গুল বা পেস্ট দিয়ে দাঁত মাজন করলে। ৩. ফরয গোসল না করে সারাদিন অতিবাহিত করলে। ৪. রোযা অবস্থায় রক্তদান করলে। ৬. পরনিন্দা, কুৎসা, অনর্থক কথা ও মিথ্যা বললে। ৭. ঝগড়া, ফাসাদ ও গালমন্দ করলে। ৮. ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে অস্থিরতা প্রকাশ করলে। ৯. মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেললে। ১০. স্ত্রীকে কামভাবের সঙ্গে স্পর্শ করলে। ১১. মুখে কিছু চিবিয়ে শিশুকে খাওয়ালে। ১২. বুটের কণার চেয়ে ছোট কিছু দাঁতের ফাঁক থেকে বের করে গিলে ফেললে।
যেসব কারণে রোযা ভাঙে না : ১. ভুলে কিছু খেলে বা পান করলে। ২. অনিচ্ছাকৃত বমি করলে। ৩. রোযা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে। ৪. অসুস্থতাজনিত কারণে বীর্যপাত হলে। ৫. স্বামী-স্ত্রী চুম্বন ও আলিঙ্গন করলে।
রোযার নিয়ত: রোযা সহিহ হওয়ার জন্য নিয়ত করা ফরয। নিয়ত হলো, অন্তর দিয়ে কোনো কাজের দৃঢ় সংকল্প করা। আরবি কিংবা বাংলায় মুখে নিয়তের উচ্চারণ করা জরুরি নয়; তবে মুস্তাহাব। তাই অন্তরে রোযা রাখার দৃঢ় সংকল্প না থাকলে তা নিয়ত হবে না। আপনি আরবীতে এভাবে নিয়ত করতে পারেন: “নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম্ মিন শাহ্রি রমাদ্বানাল মুবারাকি ফারদ্বাল লাকা, ইয়া আল্লাহু ফাতাক্বাব্বাল মিন্নি ইন্নাকা আনতাস্ সামিউল আলিম।” অর্থ: হে আলাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমযানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরয রোযা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়্যত) করলাম। অতএব তুমি আমার পক্ষ থেকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা।
ইফতারের দোয়া : “আলাহুম্মা লাকা ছুমতু ওয়া আলা রিয্ক্বিকা আর্ফ্তাতু বিরাহ্মাতিকা ইয়া র্আহার্মা রাহিমী-ন।” অর্থ: হে আলাহ! আমি তোমারই সন্তুষ্টির জন্য রোযা রেখেছি এবং তোমারই দেয়া রিযিক্বের মাধ্যমে ইফতার করছি।
ইফতার করার পর দোয়া : “যাহাবায্-যামাউ ওয়াব্তাল্লাতিল্ ‘উরূকু ওয়া সাবাতাল্ আজ্রু ইনশা-আল্লা-হু।” অর্থ: “পিপাসা মিটেছে, শিরাগুলো সিক্ত হয়েছে এবং আল্লাহ্ চান তো সওয়াবও সাব্যস্ত হয়েছে।”

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ