মানুষের ঢল আজ হাটহাজারীতে ঐতিহ্যবাহি মন্দাকিনী স্নান ও মেলা

4

হাটহাজারী প্রতিনিধি

হাটহাজারী উপজেলার ১নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে মন্দাকিনী গ্রামে আজ শনিবার (৬ এপ্রিল) স্মরণাতীত কালের ঐতিহাসিক মন্দাকিনী স্নান, তর্পণ ও মেলা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিবছর মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশী তিথিতে এই স্নান, তর্পণ ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সীতাকুন্ড জলপ্রপাত থেকে একগ্রোতি মন্দাকিনী খাল দিয়ে নেমে আসা পানিতে এই তিথিতে নিদিষ্ট লগ্নে স্নান করলে মহাপুর্ণ্যরে অধিকারী হওয়া যায়। এই বিশ্বাস সনাতনী সম্প্রদায়ের বংশ পরস্পরায় চলে আসছে। এক সময় যখন মানুষ বর্তমানের মত আর্থিক সচ্ছল ছিল না তখন লোকজন কালগত পিতামাতা তথা স্বজন এবং নিকট আত্মীয়দের পিন্ড দিতে সনাতনী সম্প্রদায়ের মহাতীর্থ খ্যাত ভারতের গয়া গিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা পিন্ড দিতে অক্ষম ছিল না তখন লোকজন নির্র্দিষ্ট এই তিথিতে মন্দাকিনী খালে স্নান তর্পণ করে প্রয়াত পিতামাতা ও স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনায় পিন্ড দিতেন। বর্তমানে মানুষ আর্থিক ভাবে সচ্ছল হয়েছে। তাই অধিকাংশ মানুষ ভারতের মহাতীর্থ গিয়ে পিতা মাতা ও স্বজনদের উদ্দেশ্যে পিন্ড দিতে চলে যায়। এরপর ও ঐতিহাসিক মন্দাকিনী জৌলসের তেমন কমতি নেই। মন্দাকিনী স্নানে উপজাতীয় নারী বিপুল সমাবেশ ঘটে থাকে। পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলা থেকে গতকাল শুক্রবার থেকে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মন্দাকিনী স্নান তর্পণ উপলক্ষে প্রয়াত জ্ঞাতিদের উদ্ধার করার লক্ষ্যে এই দিন বিপুল সংখ্যক ব্রাক্ষণ ও ধর্ম গুরু এখানে সমবেত হয়ে থাকে। তারা ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে মন্ত্রপাঠ করে প্রয়াতদের পিন্ডদান করে থাকে। এজন্য এইসব ধর্মগুরুদের দক্ষিণা ও পূজা দিতে হয়। আগত পুর্ণ্যার্থীরা ও প্রয়াত স্বজনদের উদ্ধারের জন্য ধর্ম গুরুদের চাহিদা পূরণ করতে দ্বিধা করে না।
এক সময় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ও মন্দাকিনীতে গিয়ে প্রয়াত স্বজনদের উদ্ধার করতে উপস্থিত বৌদ্ধ ধর্মগুরু তথা ভিক্ষু সংঘদের কাছ থেকে শিলাদী গ্রহণ করত এবং জল ঢালে। কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বর্তমানে সেখানে যায় না। তাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ও সেখানে যেতে দেখা যায় না। মন্দাকিনী স্নান তর্পণে অসংখ্য লোকজন সেখানে সমবেত হয় বলে জন প্রয়োজনে সেখানে মেলা বসে যায়। এই মেলায় প্রত্যেক ধর্মের মানুষ সমবেত হয়ে থাকে। তাই মন্দাকিনী মেলা সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের মিলন মেলা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। মেলায় উপস্থিত লোকজন মেলা থেকে সাংবাৎসরিক গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যাদি ক্রয় করে থাকে।
মন্দাকিনী মেলার জন্য চট্টগ্রামের লোকজন অপেক্ষা করত সংবছরের গৃহস্থালি নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ক্রয় করতে। এক সময় এই মেলা ১৫ দিন, পরে ৭ দিন বসত। সেখানে যাত্রাগান, সার্কাস, নাটক, কবিগানের আসর বসত। মেলায় আগতদের বিনোদনের জন্য রাত জেগে মেলায় আগতরা এই অনুষ্ঠান উপভোগ করত। কালক্রমে এই মেলা অনুষ্ঠান এখন দুই দিনে এসে ঠেকেছে।
ব্রিটিশ শাসনের সময় ১৯৩০ সালে নাজিরহাট শাখা রেললাইন চালু করা হলে মেলায় আগতদের সুবিধার্থে নিধারিত ট্রেন ছাড়া ও অতিরিক্ত ট্রেন চালু করেছিল। তখনকার সময় বর্তমানের মত বাস তথা নানা রকম গাড়ি ছিল না। তাই তৎকালীন সরকার মেলার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আগতদের সুবিধার্থে এই অতিরিক্ত ট্রেন চালু করেছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে মেলার জৌলশ কিছুটা কমে যাওয়া এবং পর্যাপ্ত যানবাহন চালু থাকায় এখন রেল কর্তৃপক্ষ মেলা উপলক্ষে অতিরিক্ত ট্রেন বন্ধ করে দেন। ট্রেন চলাচল না থাকলে ও মেলায় আগতদের তেমন অসুবিধা হয়না। কারণ এখন পূর্বের মত যানবাহনের স্বল্পতা নেই।
উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ১নং ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ, মেলা কমিটি মন্দাকিনী স্নান ও মেলা অনুষ্ঠান সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের জন্য ইতিমধ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। স্নান তর্পণের জন্য আগতদের সুবিধার্থে হাটহাজারী সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য ও বর্তমানে বিরোধী দলীয় উপনেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ মেলা সংলগ্ন মন্দাকিনী খালে পাকা ঘাট করে দিয়েছেন। খালে পানি জমা রাখার জন্য স্নান সংলগ্ন স্থানে ক্রসবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। মেলায় আগত দোকানী ও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য বিক্রির জন্য পসরা নিয়ে দোকান খুলে বসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মন্দাকিনী মেলাস্থলের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত থাকায় মেলাস্থল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল।
মন্দাকিনী মহাতীর্থ পরিচালনা পরিষদের পক্ষ এ উপলক্ষে দিনব্যাপী বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মন্দাকিনী স্নান ও তর্পণ, মহিলাদের স্নান করে কাপড় পরিবর্তনের জন্য ঘেরা দেওয়া হয়েছে, শ্রী শ্রী শিব পূজা, শ্রী শ্রী চন্ডীপাঠ, বিশ্বশান্তি গীতাযজ্ঞ ও মহাপ্রসাদ বিতরণ। মন্দাকিনী মহাতীর্থ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দ প্রসাদ মহাজন ও পাঁচকড়ি শীল ইতিমধ্যে মেলা আয়োজনের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আয়োজক কমিটি মেলা অনুষ্ঠান সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদ ও সর্বস্তরের লোকজন সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছেন। নেতৃবৃন্দ এই মেলা একক কোন সম্প্রদায়ের নয় বলে উল্লেখ করে এই মেলা ঐতিহ্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের মিলন মেলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।